অনন্যা সরলা

১৮৭২ সালে আজকের দিনেই কোলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সরলাদেবী চৌধুরানী। সাহিত্যিকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত ও ফরাসি ভাষাতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন সরলা। সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী।

শৈশবের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, ফলে তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পাঠ। পিতা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন নদীয়ার জয়রামপুরের জমিদার এবং জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা সাহিত্যিক। কোলকাতার বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্সের পর বেথুন কলেজ থেকে এফএ এবং ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন সরলাদেবী। বি.এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তিস্বরূপ অর্জন করে নিয়েছিলেন ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’।

মহীশূরের মহারাণী গার্লস স্কুলে বেশ কিছুকাল শিক্ষকতায় রত ছিলেন সরলাদেবী। তাঁর সময়ের প্রথম রাজনৈতিক নারী নেত্রীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ। প্রায় শতাধিক দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়েছে তাঁর কলমে। ব্রিটিশরাজের বিরূদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর এই গানগুলি হয়ে উঠেছিল তাঁর শাণিত অস্ত্র। সঙ্গীতের মাধ্যমেই এই আন্দোলনকে প্রকৃত রূপ দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন চৌধুরাণী। শুধু নিছকই গান গাওয়া নয়, ব্রিটিশ শোষণের দাসত্ব থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে মানুষদের জাগিয়ে তোলাই ছিল তাঁর সঙ্গীত রচনার মৌলিক উদ্দেশ্য।

‘বন্দে মাতরম’-এর প্রথম দুই লাইন রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করলেও গানটির বাকি অংশের সুরবিস্তার করেছিলেন সরলাদেবী। ৩৩ বছর বয়সে আইনজীবি তথা সাংবাদিক রামভজ দত্ত চৌধুরীর সাথে তাঁর বিবাহপর্ব সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর পাঞ্জাবে পারি দিলে সেখানকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন এই দম্পতি। উর্দু সাপ্তাহিক ‘হিন্দুস্তান’-এর দায়িত্বভার সামলানোয় স্বামীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সরলাদেবী।  রাওলাট আইন পাশ হওয়ার পর জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকান্ড নিয়ে দেশ জুড়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরূদ্ধে তীব্র ধিক্কার শুরু হলে সরলা ও তাঁর স্বামী রামভজ তাঁদের পত্রিকায় এ নিয়ে তীব্র সমালোচনায় মুখর হন। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রাজদ্রোহের জেরে গ্রেপ্তার হন রামভজ। এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রামভজ এই পত্রিকার মালিকের পদে বহাল থাকলে পত্রিকাটির লাইসেন্স বাতিল করবে ব্রিটিশ সরকার। পরিস্থিতি বুঝে পত্রিকাটির মালিক ও সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সরলাদেবী এবং জীবিত রাখার পাশাপাশি পত্রিকাটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করতেও তিনি সমর্থ হন।

জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যতীন্দ্রমোহন বন্দোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম গুপ্ত দল সংগঠনে সহায়তা করেছিলেন এই নারী। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থাপন করেছিলেন তাঁতবস্ত্র প্রচার ও লক্ষীর ভান্ডার। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’। কোলকাতা শহরেও এর অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত স্ত্রীশিক্ষা সদন’ (১৯৩০) গড়ে তোলায় অগ্রজ ভূমিকা গ্রহণ করেন তিনি; মহিলাদের মধ্যে তরবারি চালনা, লাঠি খেলা ইত্যাদি প্রচলিত করেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূত্রে লালা লাজপত রায়, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, বালগঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখের সঙ্গে সরলাদেবীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন সরলা।

১৯০০ সালে সরলাদেবী রচিত দেশাত্মবোধক গানের একটি সংকলন গ্রন্থ শতগান পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে বাঙালির পিতৃধন (১৯০৩), ভারত-স্ত্রী-মহামন্ডল (১৯১১), নববর্ষের স্বপ্ন (গল্প,১৯১৮), জীবনের ঝরাপাতা (আত্মজীবনী, ১৯৪৫), বেদবাণী  (১১ খন্ড), শিবরাত্রি পূজা ইত্যাদি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়েছিল ভারতী, সখা ও বালক পত্রিকায় রচনা প্রকাশের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা রাখেন চৌধুরাণী। অগ্রজা হিরন্ময়ী দেবীর সাথে যৌথভাবে ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন দীর্ঘকাল।  

১৯৩৫ সালে শিক্ষাজগৎ থেকে অবসর নিয়ে ধর্মীয় জীবনে ফিরে আসেন সরলাদেবী। প্রথম জীবনে থিওসফিক্যাল সোসাইটি এবং পরে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হলেও শেষজীবনে তিনি বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মাকে গুরুপদে বরণ করে নেন।

১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট কোলকাতার ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জীবনাবসান হয়। ভারতীয় নারীদের একত্রিত করাই ছিল জীবনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ভারতীয় সাহিত্যে ও স্বদেশী আন্দোলনে অনস্বীকার্য অবদান থাকায় ভারতবাসীর হৃদয়ে বহমান থাকার পাশাপাশি ইতিহাসের পাতাতেও চিরকাল প্রজ্বলিত থাকবে তাঁর নাম।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...