তাঁর নিজের কথায় তিনি, ‘সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়— সত্য জননী।’ অপার মাতৃস্নেহ, তিনি সকলেরই মা। গ্রামের এক সাধারণ মহিলা, এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। অথচ নিবেদিতা, সারা বুল, মিস ম্যাকলয়েডদের সঙ্গে দিব্যি কথা বলেন, আহার করেন এঁদের সকলের সঙ্গে। সত্যিই তিনি সকলের মা। সত্য জননী। নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন- আমি সতেরও মা, অসতেরও মা। আবার ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভক্তদের কাছে বলেছিলেন- ও সারদা, সাক্ষাৎ সরস্বতী!
পরমহংসদেবের সাধনপথে সহযোগিতা করেছেন মা সারদা। সংসারের মধ্যে রামকৃষ্ণদেবকে আবদ্ধ করে রাখতে তিনি আসেননি, বরং ‘যত মত তত পথ’-এর দিশারী ঠাকুরকে সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়াই ছিল মায়ের শ্রেষ্ঠ কাজ। ভক্তদের উদ্দেশে তিনি বলতেন, ‘আমি আর কী উপদেশ দেব। ঠাকুরের কথা সব বইয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তাঁর একটা কথা ধারণা করে যদি চলতে পার, তো সব হয়ে যাবে।’
১৮৫৯ সালের মে মাসে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে মায়ের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ঠাকুর ও শ্রীমায়ের বিবাহ ছিল এক আধ্যাত্মিক বন্ধন। রামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বর থেকে যখন কামারপুকুরে আসেন, মাকে তখন তাঁর পিতৃগৃহ জয়রামবাটি থেকে নিয়ে আসা হত। ঠাকুর তাঁকে নিজের হাতে একটু একটু করে তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্গিনী হিসেবে গড়ে তোলেন।
সারদা তাঁর কাছে জীবন্ত ভগবতী। সাত বছর বয়সে, নয় বছর বয়সে, চোদ্দো বছর বয়সে সারদা বার বার রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসেছেন। রামকৃষ্ণের হাতে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলেছে সর্বক্ষণ। সারদার বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি পদব্রজে জয়রামবাটি থেকে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে পৌঁছলেন। পথকষ্টে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। অসুস্থ অবস্থায় এসে পৌঁছলেন। রামকৃষ্ণ প্রাণ দিয়ে স্ত্রীর শুশ্রূষা করলেন, পথ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভাল করে তুললেন।
সেই সময় ঘটল তাঁদের যুগ্ম আধ্যাত্মিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে পূজা করলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করেছেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি সারদাতে আরোপিত করলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিলেন। ফলহারিণী কালীপূজার পুণ্যদিনে ঠাকুর এই ষোড়শী পূজা করেছিলেন। সারদা তখন ষোড়শী নন, অষ্টাদশী।
শক্তিরূপিণী মায়ের এক নাম ষোড়শী। ষোড়শী অবশ্য রাজরাজেশ্বরী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামেও পরিচিত। ঠাকুরের এই ষোড়শী পুজা, নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চেতনানন্দ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন— রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন— বুদ্ধ, চৈতন্য। রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন না, তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা!
ঠাকুরের কাছে আসা যাওয়ার পথে মাকে বিপদেও পড়তে হয়েছে। ভয়ঙ্কর ডাকাতের মুখোমুখি হয়েছেন মা। অন্ধকার বিপদসঙ্কুল পথে মা হেঁটে চলেছেন হঠাৎ সেই ডাকাত তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘কে তুমি’? প্রচণ্ড সাহসিনী মা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘আমি তোমার মেয়ে সারদা’। এর পরের কাহিনি সবার জানা। এ রকম শুধু একজন বা দু’জন ডাকাত বা বিপথগামী মানুষ নয়, আরও কত শত মানুষকে তিনি জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। এ কারণেই তিনি বিশ্বজননী।
১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর, বাংলা পঞ্জিকা মতে ১২৬০ সালের ৮ই পৌষ, বৃহস্পতিবারে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবীর কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন সারদামণি। মা নিজের মুখেই তাঁর যে জন্মবৃত্তান্তটি বলে গিয়েছেন ভক্তদের, 'আমার মা শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছা হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান। শৌচের কিছুই হলো না, কিন্তু বোধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদরমধ্যে ঢোকায় উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল। বসেই আছেন। তখন মা দেখেন লাল চেলি পরা একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তাঁর কাছে এসে কোমল বাহু দুটি পিঠের দিক থেকে তাঁর গলায় জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমার ঘরে এলাম মা। তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে; তা থেকেই আমার জন্ম।'
তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্ষেমঙ্করী। মায়ের নিজের কথায়, 'আমি হবার আগে, আমার যে মাসিমা এখানে সেদিন এসেছিলেন, তাঁর একটি মেয়ে হয়। মাসিমা তার নাম রেখেছিলেন সারদা। সেই মেয়ে মারা যাবার পরেই আমি হই। মাসিমা আমার মাকে বলেন, দিদি, তোর মেয়ের নামটি বদলে সারদা রাখ; তাহলে আমি মনে করব আমার সারদাই তোর কাছে এসেছে এবং আমি ওকে দেখে ভুলে থাকব। তাইতে আমার মা আমার নাম সারদা রাখলেন।'
ঠাকুর তাঁকে ঠিকই চিনেছিলেন। পরে ভক্তরা চিনেছিলেন শক্তির বিশুদ্ধ প্রকাশ হিসেবে। যার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং ঠাকুরই! জানিয়ে গিয়েছিলেন- তাঁর অবর্তমানে ছেলেদের সহায় হবেন এই মা। ঠাকুরের অবর্তমানে মাকে ঘিরেই চলছে ছেলেদের যাবতীয় কাজকর্ম। তাঁদের কাজ, আনন্দ- সবেরই মধ্যমণি তখন মা। দেবী আর মাতৃত্ব- এই দুই অনায়াসে দুই হাতে বহন করে চলেছেন তিনি।
কেমন করে মায়ের জন্মদিবস পালন করা হত? ব্যক্তিগত ভাবে জন্মতিথিতে বিশেষ আয়োজন করা তেমন পছন্দ ছিল না মায়ের। জানা যায়, ১৯০৭ সালে জয়রামবাটিতে জন্মদিনে কী হবে জানতে চাইলে মা বলেছিলেন- “আমি একখানা নতুন কাপড় পরব, ঠাকুরকে একটু মিষ্টান্নাদি করে ভোগ দেওয়া হবে, আমি প্রসাদ পাব। এই আর কি।”
মাঝে মাঝে আবার নিজের জন্মতিথির কথা খেয়ালও থাকত না তাঁর। একবার জন্মতিথিতে, মা তখন কলকাতায় গঙ্গাস্নান সেরে, বাড়িতে ফিরে তিনি লক্ষ্য করেন যোগীন-মায়ের ব্যস্ততা। মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, “এসব কি গো যোগেন? মায়ের দিকে একটু চেয়ে থেকে, গভীর প্রীতির সঙ্গে মায়ের চিবুক স্পর্শ করে যোগীনমা বললেন, আজ যে তোমার জন্মতিথি, মা!” মা হেসে বললেন, “ও মা তাই? ”!
জগদ্ধাত্রী পুজোর কিছু দিন পরেই মায়ের জন্ম হয়। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। তাই এই সময়টা সচরাচর জয়রামবাটি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেন না মা, জন্মতিথি বেশির ভাগ সময়েই জয়রামবাটিতে কাটত। সেখানে যখন তাঁর জন্মতিথি পালনের তোড়জোর চলত, তখনও মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনিই। আত্মীয়রা যাতে জন্মতিথিতে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট না হয়, সে দিকে সজাগ নজর রাখতেন মা।
আবার, গ্রামবাসীরাও যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি রেখে সাধ্যমতো আয়োজন করতে হত উৎসবের। সামান্য মানুষের সাধ্য কী, এমন ভাবে সব দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করা!
মায়ের ভাই, যাঁকে সবাই কালীমামা বলেই ডাকতেন, তিনি মায়ের জন্মতিথির সব আয়োজনের ভার নিজেই বহন করতে চাইতেন। গোল বাধিয়ে দিতেন। একাধিকবার এমন হয়েছে, তিনি যাতে গোল না করেন, সেই দিকে বিশেষ সজাগ থাকতেন মা। সেই জন্য একবার বরদা মহারাজকে ছোট করে উৎসব করার ভার দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন মা স্বয়ং।
বরদা মহারাজকে ডেকে বলেন- “দেখ বরদা, এবারে কোতলপুরের হাট কালীকে দিয়েই করাতে হবে, কদিন থেকে এর জন্য সে ঘোরাঘুরি করছে…. শেষে চটেমটে একটা কাণ্ড বাধাবে।“ এ শুধুই মায়ের তুখোড় বুদ্ধির নিদর্শন নয়, সেই সঙ্গে করুণাও। তিনি ভালই জানেন- ভাইয়ের উৎসবের সর্বময় কর্তা হওয়ার বাসনা যতখানি, তার চেয়ে ঢের বেশি ইচ্ছা দিদির জন্মতিথিটি নিজের উদ্যোগে সুসম্পন্ন করা। বুঝতে পেরে সেই ইচ্ছাও পূরণ করেছেন মা।
একবার জন্মতিথিতে দেখা গেল, পুজো হয়ে যাওয়ার পরে এক ভক্তের দেওয়া তসরের কাপড় আর রুদ্রাক্ষের মালা পরে মা বসেছিলেন তাঁর ঘরে খাটের দক্ষিণ দিকে মাটিতে পা রেখে। ভক্তরা একে একে এসে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে যাচ্ছিলেন। মায়ের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করছিলেন। যা ছিল তাঁর জন্মতিথি পালনের দস্তুর। মাঝে মাঝে জন্মতিথিতে তাঁর ভাবসমাধি হত।
তাঁর জীবদ্দশায় শেষ জন্মতিথিটি হয়েছিল ১৯১৯ সালে। সেবার মায়ের শরীর ভাল ছিল না। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ যার বর্ণনা, “তাঁর শুভ জন্মতিথির দিন উপস্থিত হইলে শ্রীশ্রীমা বেশি ঝঞ্জাট করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, ভক্ত ছেলেগুলি যারা আছে আর প্রসন্ন, কালীদের বাড়ির সবাইকে বলে দাও।“ সেই শেষ জন্মতিথির উৎসবেও দেবী আর মাতৃসত্ত্বা মিশে গিয়েছে। সেদিন অল্প তেল মেখে সামান্য গরমজলে গা মুছে, শরৎ মহারাজের পাঠানো শাড়ি পরে মা চৌকিতে বসার পরে একে একে সবাই পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করতে থাকেন। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মাকে একটি গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে প্রার্থনা জানান- যে ভক্তরা তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পায় না, তিনি যেন তাঁদেরও মঙ্গল করেন। তখনও কেউ জানতেন না, মা অচিরেই চলে যাবেন। কেউই আর তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পাবে না। ১৯২০ সালে জন্মতিথি আসর অনেক আগেই মা রামকৃষ্ণলোকে পাড়ি জমান।