শ্রীচরণেষু সন্তু মুখোপাধ্যায়

সেই যে বছর বাংলার প্রেক্ষাগৃহে মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত 'অগ্নিশ্বর', 'আমি সে ও সখা', 'প্রিয় বান্ধবী', 'বাঘবন্দী খেলা', 'সন্ন্যাসী রাজা'-র মতো ছবিগুলো বাঙালিকে মাতিয়ে তুলেছিল, যে বছর রঞ্জিত মল্লিক 'মৌচাক', 'রাগ অনুরাগ' ও 'স্বয়ংসিদ্ধা' ছবিতে বাঙালির কাছে স্নিগ্ধ নায়কত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ; সেই ১৯৭৫ সালে বাংলা সিনেমা জগতে পা রেখেছিলেন তরুণ অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায়। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। একই বছরে দুই দিকপাল চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিনহা ও তরুণ মজুমদার--দুজনের দুই ছবিতে। তার মধ্যে তপন সিনহার 'রাজা' ছবিটিই আগে মুক্তি পেয়েছিল। পয়লা অগাস্ট; একইসঙ্গে মিনার, বিজলী ও ছবিঘরে। আর তরুণ মজুমদারের 'সংসার সীমান্তে' ছবিটি মুক্তি পায় তেসরা অক্টোবর; সেও একইরকমভাবে মিনার, বিজলী, ছবিঘরে। প্রথমটির নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়, দ্বিতীয়টির সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

সাতের দশকের মাঝামাঝি ছিপছিপে মধ্যবিত্তসুলভ চেহারার সন্তু মুখোপাধ্যায় যে যে গুণ থাকলে পরিপূর্ণ একজন অভিনেতা হওয়া যায়, সেই গুণগুলোকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত করেই কাজে নেমেছিলেন। তিনি সুকণ্ঠের অধিকারী তো ছিলেনই। সেইসঙ্গে স্বরপ্রক্ষেপণ, শাস্ত্রীয় নাচ, গান সবেতেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তপন সিনহা ও তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকেরা তাঁর সেই গুণগুলোকে একাধিক ছবিতে সুযোগ বুঝে ব্যবহার করেছেন। যেমন, তনুবাবু 'ভালোবাসা ভালোবাসা' ছবিতে তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্লেব্যাক করিয়েছেন। আবার এঁদের সাহচর্য সন্তু মুখোপাধ্যায়কে আরো পরিশীলিত হবার সুযোগ দিয়েছে।  তারই ফলে পরবর্তী চারটে দশক ধরে তিনি সিনেমা, নাটক, বেতার, যাত্রামঞ্চ ও দুরদর্শনের পর্দায় একজন শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। তপন সিনহার 'হারমোনিয়াম' (১৯৭৬), গুরু বাগচীর 'টুসি' (১৯৭৮), তরুণ মজুমদারের 'গণদেবতা' (১৯৭৯), উত্তমকুমারের 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী'(১৯৮১), সুশীল মুখোপাধ্যায়ের 'বৈকুণ্ঠের উইল'(১৯৮৫),  অঞ্জন চৌধুরীর 'বিদ্রোহী'(১৯৮৭) তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি। সিনেমা না হলেও নাটক এবং যাত্রাপালায় তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন আটের শেষ ও নয়ের দশকের শুরুতে। এই পর্বে তাঁর উল্লেখযোগ্য পালাগুলোর মধ্যে রয়েছে সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'অরণ্যের বাগদত্তা' (ভারতী অপেরা) এবং পালাকার সুকুমার রায় রচিত 'কমলা কেমন আছো?'(চন্দ্রলোক অপেরা)।

সন্তু মুখোপাধ্যায় শিল্পের ক্ষেত্রে যে মননশীলতা লালন করতেন, তা কখনো জাহির করেননি, করতেও চাননি। সন্তু মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা হলেন এই কলিকাতা কমলালয়ে 'কিন্নরদল'। গান শুনিয়ে স্বস্থানে ফিরে যান। কিন্তু তাঁর মতো প্রতিটি মানুষ ও শিল্পীর মৃত্যু এখনও একটা করে প্রশ্ন রেখে যায়, একটা করে আক্ষেপ রেখে যায়-- মৃত্যুর আগে তাঁর কাজের প্রকৃত মূল্যায়ন কেন আমরা করলাম না? কেন তাঁর সারাজীবনের শিল্প ও সাহচর্যের অভিজ্ঞতা ভাবীকালের জন্য সঞ্চয় করে রাখলাম না?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...