পেশায় ছিলেন আইনজ্ঞ আর নেশায় অভিনেতা। আবার ব্যাঙ্কেও চাকরি করেছেন জীবনের শুরুতে। মঞ্চ থেকে রুপোলি পর্দা তিনি দাপিয়ে বেরিয়েছেন সর্বত্র। বলা ভাল রাজত্ব করেছেন। দর্শকদের হৃদয়ে তিনি আজও উজ্জ্বল। ওগো বধূ সুন্দরীর অবলাকান্ত হোক বা হাল্লা সুন্ডির রাজা সবেতেই তিনি ফিট। আবার কখনও হীরক রাজার দেশের গবেষক তো কখনও টেনিদা, মহাপুরুষেও তিনি সমান শ্বাশত। তবে বাঙালি তাঁকে সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে জটায়ু হিসেবে। সেই সোনারকেল্লায়... তাং মথ কারো তাং মথ কারো, কাফি হো গিয়া যাদা হো গিয়া! আজ কাল্ট হয়ে গিয়েছে। সোনারকেল্লায় শুরু হয়ে কাশিতে জয় বাবা ফেলুনাথ-এ শেষ। সত্যজিৎ আর ফেলু নিয়ে ছবিই বানালেন না কারণ সন্তোষ নেই! ভাবা যায় একটা পার্শ্ব চরিত্র নেই তাই নির্দেশক ছবি বানাবেন না। অভিনেতা কতটা অপরিহার্য হলে এমন হয়। এক্কালে সন্তোষ দত্তের মতোই বইয়ের পাতার জটায়ুর অলংকরণ করেছিলেন সত্যজিৎ। সন্তোষ দত্ত গাড়ি কেনার পরে জটায়ুকেও গাড়ি দিয়েছিলেন জটায়ু। মানুষটি এতোটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল চরিত্রের সঙ্গে।
মানিকতলা চত্বরে এক অতি সাধারণ বাড়িতে থাকতেন রিয়েল জটায়ু! ছায়া সিনেমা হলের পাশে দিয়ে যে রাস্তাটা আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকের রাস্তার এক গলিতে দোতলা পৈতৃক বাড়িতে থাকেন তিনি। বাড়ির নাম সুরধনী কুটির। নীচের তলায় চেম্বার, রান্নাঘর, বাথরুম আর ওপর তলায় দুটো ঘর। তখন তিনি রীতিমতো বিখ্যাত অভিনেতা, এক ডাকে লোকে তাঁকে চেনেন। অথচ তখনও তিনি কোর্ট যেতেন তেরো নম্বর ট্রামে করে। লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিবাসে ফিরতেন। খ্যাতির বিড়ম্বনায় বাস-ট্রাম ছেড়ে কদিন ডালহৌসি থেকে মানিকতলা হেঁটেও ফিরেছিলেন। এমটাই সাদামাটা ছিল তাঁর জীবন।
যদিও শেষে এক সিনিয়র ব্যারিস্টার জে কে দাস চাপে গাড়ি কিনেছিলেন। নেভি ব্লু রঙের অ্যামবাসাডর, যার নম্বর ডব্লু বি এফ ৬৮৮। এক সময় এই গাড়িটিকেই গোটা কলকাতা জটায়ুর গাড়ি বলে জানত। এমনকী তিনি গাড়ি কেনার পরেই সত্যজিৎ রায় গল্পের জটায়ুকে গাড়ি কিনিয়েছিলেন, তবে রিলের জটায়ুর গাড়ির রং ছিল সবুজ। আদ্যন্ত ফ্যামিলিম্যান ছিলেন তিনি, রান্না শখ ছিল প্রবল। ছুটির দিন হলেই বাজারে গিয়ে নিজের হাতে মাংস আনতেন। জমিয়ে রাঁধতেন! কিন্তু নিজে ছিলেন স্বল্পাহারী। এই মানুষটি যার নামই হয়ে গিয়েছে জটায়ু তিনিই কিনা জটায়ুর ভূমিকা থেকে বাদ পড়ছিলেন, ভাবা যায়!
আর একটু হলেই সোনার কেল্লা থেকে ছিটকে যেতেন জটায়ু সন্তোষ দত্ত!
একটা হত্যাকাণ্ডের মামলা চলছে কোর্টে। তার মধ্যেই একদিন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি থেকে ফোন পেলেন উকিলবাবু। ফোন রেখেই গম্ভীর মুখে জুনিয়ারকে বললেন, "এ তো মহা মুশকিলে পড়লাম দেখছি। মানিকদা ফোন করেছিলেন। আমাকে জটায়ু করার জন্য বললেন। রাজস্থানে এক মাসের শ্যুটিং। যেদিন যাবার কথা সেদিনই মামলার শুনানি। কী করি বলো তো?"
তদানিন্তন সময়ে আদালতে কেসের ডেট পড়লে এত সহজে ডেট বদলে নেওয়া যেত না। তারিখ পে তারিখ হত না আর কী! অগত্যা কী করবেন, সোজা ফোন কর বসলেন বিরোধী পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরকে। খুলে বললেন সব। বন্ধুবরের উত্তর, 'অত ঘাবড়াবার কী আছে? শুনানি যাতে না হয় তার সব বন্দোবস্ত আমি করব। তুমি শুধু একটা পিটিশান করে নিয়ে এসো।'
শুনানি চলছিল বিচারপতি শচীন সান্যালের এজলাসে। পিটিশান নিয়ে তাঁর ঘরে হাজির হলেন জটায়ু। পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন সব। সঙ্গে এও বললেন, 'মামলাটা যদি এক মাস পিছিয়ে যায়, আমার কোনও আপত্তি নেই।' শচীন সান্যাল সব শুনে বললেন, 'ঠিক আছে, আপনি ওঁর বিরোধী হয়েও যখন এ কথা বলছেন, আমি অ্যালাও করে দিচ্ছি।' আর কোন বাধা রইল না, এইভাবেই জটায়ু হয়ে উঠলেন সন্তোষ দত্ত। রাজস্থানের মরুভূমিতে দুষ্টু লোকেদের পিছনে ধাওয়া করে মুকুলকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান শেষ হল। বাঙালির মনে জায়গা করে নিলেন তৃণমূর্তি, ফেলু-তোপসে-জটায়ু অমর হয়ে গেল!
এরপরে জয় বাবা ফেলুনাথ। কাশিতে মগনলাল মেঘরাজের ডেরা। এই দুুদে ভিলেন নাজেহাল করল জটায়ুকে। তবে সত্যজিতের লেখা থেকে জানা যায় রাজস্থানের উটের মতোই কাশিতে কোন সার বাবাজি বেশ তাং করেছিলেন থুড়ি জ্বালিয়েছিলেন রিয়েল জটায়ুকে।
'আংকেল ও শরবতে বিষ নাই! হামি জানে বিষ খুব খারাপ জিনিস। অর্জুন কো বুলাও সাথ তেরা নাম্বার বাক্স ওর তক্তা লাগাও।' সেই বিখ্যাত শট। জটায়ুকে দাঁড় করানো হয়েছে, পিছনে পিঠ ঠেকিয়ে। উল্টো দিকে ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ 'অর্জুন' কামু মুখার্জী।
অর্জুনের হাতের ছোরা একে একে গিয়ে বিঁধবে জটায়ুর আশেপাশে। শোনা যায়, এ দৃশ্যর কথা আগের দিনই সত্যজিৎ রায় বলে দিয়েছিলেন। সকালে শ্যুটিং যাবার আগে সন্তোষ বাবু তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'আজ কী যে হবে জানি না বাপু। মানিকদা যা সব ছোরাছুরির কথা বলছিলেন, একটু এদিক ওদিক হয়ে গায়ে না গেঁথে যায়!' পরে অবশ্য হাসতে হাসতে এ গল্প বহুবার করেছেন তিনি নিজেই। জটায়ু হিসেবে এটিই ছিল তাঁর শেষ ছবি। তাঁর মৃত্যুকে ফেলু সিরিজের গল্প নিয়ে ছবি বানানোও বন্ধ করে দেন পরিচালক সত্যজিৎ।