গৃহত্যাগী সাধক একনাথ স্বামীকে কেন বিবাহের নির্দেশ দিয়েছিলেন গুরু?

বৈষ্ণবরা কি শুধুই দিনরাত হরিভজন করেন? দেশকে স্বজনকে রক্ষায় তারা কি অস্ত্র ধারণ করে না? বৈষ্ণব মানেই কি ত্যাগ তিতিক্ষার জীবন? গৃহীরা কি বৈষ্ণব নয়- এই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর মেলে সাধক শ্রেষ্ঠ একনাথ স্বামীর জীবন দর্শন দেখলে। দাক্ষিণাত্যের দেবগড় দুর্গের অভ্যন্তরে তখন সকলে ঘুমিয়ে আছেন। গভীর রাত, চারিদিক শুনশান,অন্ধকার! হঠাৎ করেই  রাত্রির নীরবতা ভঙ্গ করে শত্রুর আক্রমণ! শত্রু সেনা কেল্লা আক্রমণ করে। কিন্তু দুর্গের মালিক জনার্দন স্বামী তখন ধ্যান করছেন। তাই তিনি বাধা দিলেন না। অন্যদিকে কোনও বাধা না পেয়ে সেনাবাহিনী পাহাড়ের উপরে কেল্লার দিকে উঠতে থাকে সামনে বিপদ দেখে এক মুহূর্তে নিজে কর্তব্য স্থির করেন একনাথ। গুরুদেবের ঘরে ঢুকে তিনি তার অস্ত্র ও বর্ম পরে নিজেকে সাজিয়ে নেন , তারপর দ্রুত বেগে দুর্গের উপরে ওঠে দেবগড়ের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন শত্রু সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। তার অসম সাহসিকতা ও প্রত্যুতপন্নমতিত্বে সেইদিন রক্ষা পেল দেবগড়।  ধ্যান থেকে উঠে তাঁর গুরু জনার্দন স্বামী একনাথের করা সমস্ত কার্যের কথা শুনে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন কর্তব্যপরায়ণ ভক্ত একনাথ স্বামীকে। কিন্তু কে এই একনাথ স্বামী? কী বা তার পরিচয়? 

এক মহান সাধকের বংশধর ছিলেন একনাথ। তার  প্রপিতামহ ছিলেন প্রতিষ্ঠানপু্র বা পৈঠানের সাধক শ্রেষ্ঠ ভানু দাস। যিনি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানদের অত্যাচার দমন করে পন্ধারপুরের বিঠঠ্লজি  বিগ্রহের পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। মারাঠাদের ভক্তি আন্দোলনের উৎসই ছিল এই জায়গা। এখানকার জাগ্রত দেবতা বিঠঠলজিকে কেন্দ্র করে প্রেম ভক্তির প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। এখানকারই দুজন বৈষ্ণব সাধকের মধ্যে একজন ছিলেন জ্ঞানদেব, অপর জন ছিলেন নামদেব। এই দুই সাধকের আবির্ভাবের প্রায় দুই শতাব্দী পর ১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন একনাথ। 

ভানু দাসের নাতি সূর্য নারায়ণ ও নাতবৌ রুক্মিণী বাঈয়ের  ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন একনাথ। শৈশবেই তিনি তার বাবা-মাকে হারান এবং ঠাকুরদা ও ঠাকুমার কাছে মানুষ হতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তার অদ্ভুত মেধা, যা কিছু শুনতেন সব মনে রাখতে পারতেন‌। গ্রামের শিব মন্দিরে পুরাণ ও শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনে সে মুগ্ধ হয় এবং ধ্রুবপ্রহ্লাদের জীবন কাহিনী তাকে রীতিমত অনুপ্রাণিত করে। এই সময় থেকেই তাঁর মনের মধ্যে বৈষ্ণব ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। 

এরপর যখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর, তখন একদিন সে দৈবাদেশ পায়,  একনাথ জানতে পারে যে, দেবগড়ের কেল্লাদার জনার্দন স্বামী তাঁর গুরু, তার কাছে গেলেই সে অভীষ্ট মন্ত্র পাবে, পাবে সাধন-মার্গের পথ। সেই দিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সে একাই খালি পায়ে হেঁটে রওনা দেয় দেবগড়ের উদ্দেশ্যে। নিজের আধ্যাত্মিক জীবনের সবথেকে বড় অবলম্বন গুরুর উদ্দেশ্য। গুরুকে গিয়ে যখন সে দৈবাদেশের কথা বলে তখন জানার্দন স্বামী তাঁকে কাছে টেনে নেন,দীক্ষা দেন এবং ভক্তি সাধনার যাবতীয় তথ্য দান করেন।

এইভাবে গুরুগৃহে  আরও ছয় বছর কাটানোর পর গুরু তাঁকে একদিন ডেকে বলেন, তোমাকে এবার উপলব্ধি করতে হবে শ্রীমৎ ভাগবতের পরম তত্ত্ব। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুতেই পরিব্যপ্ত হয়ে আছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ সেবায় তোমার জীবনের একমাত্র কাঙ্খিত বস্তু হোক। তাই আমি স্থির করেছি তোমাকে আধ্যাত্ম সাধনার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবন সাধনার ও শিক্ষা দেব‌। এই দুটোকে মিলিয়ে সার্থক করতে হবে তোমার ভাগবত সাধনা। - এই দুই সাধনা বলতে কী বোঝায় সেটা একনাথ তখন বুঝতে পারেননি, কিন্তু গুরু যখন তাঁকে বিবাহের নির্দেশ দিলেন সেই সময় তিনি গুরুর বক্তব্য পুরোপুরিভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।


গুরুর থেকে এই মন্ত্র পেয়ে ব্যবহারিক জীবনের কর্তব্য সম্পর্কেও তিনি পাঠ নিলেন এবং বিভিন্ন কর্মে সাফল্যের পরিচয় দিলেন। তারপর উনি  দীর্ঘকাল পথে পথে পর্যটন করতে থাকলেন এবং দীর্ঘ সময় পর আবার মিলিত হলেন গুরুর কাছে গুরু তখন সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, একনাথ এবার হবে তোমার অগ্নিপরীক্ষা, তোমাকে বিয়ে করতে হবে, তোমাকে  বিবাহ করে সংসারী হতে হবে। হ্যাঁ, তবে বিবাহ করলেও তুমি জীবন যাপন করবে অনাসক্ত  ভক্তের মতো। আমার আরও নির্দেশ সকলের জন্য সহজ ভাষায় তুমি রচনা করবে ভক্তি গ্রন্থ। তাহলেই ভক্তি সাধনার তথ্য ছড়িয়ে পড়বে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। 

গুরুর আদেশ না মেনে উপায় ছিল না , তাই একনিষ্ঠ ভক্ত একনাথ গ্রামে ফিরে এলেন। ঠাকুরদা ও ঠাকমা তখনও বেঁচে , তারা গিরিজা বাঈ নামে এক ভালো  ব্রাহ্মণ মেয়েকে খুঁজে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। একনাথের ভক্তি সাধনা ও ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে সহযোগিতা করেন পতিব্রতা গিরিজাবাঈ। অন্যদিকে একের পর এক ভক্তি গ্রন্থ রচনা করতে থাকেন একনাথ। কখনও রচনা করেন ‘একনাথী ভাগবত’ , কখনও রচনা করেন ‘ভাবার্থ রামায়ণ’। শত লোকের মুখে ছড়িয়ে যায় তাঁর খ্যাতির কথা। তাঁর অঙ্গনে এসে প্রচুর মানুষ ভগবানের নাম কীর্তন করতে থাকেন, তবে তিনি এই সমস্ত কিছুর জন্য সর্বদায় ঋণ স্বীকার করেন তার গুরু জনার্দন স্বামীর কাছে।

ভাগবতকে তিনি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভাগবত হচ্ছে একটা বড় ক্ষেত, ব্রহ্মা প্রথম এর মধ্যে শস্য বীজ দেন  এবং ক্ষেত্রপতি  নারদ ঐ শস্য বীজ বপন করেন নিপুন হাতে, ব্যাসদেব ওই ক্ষেতের নিরাপত্তার জন্য দশটি বাঁধ দিয়ে এর চারিদিকে বেঁধে দেন ফলে সেই ক্ষেত ভরে উঠে দিব্য আনন্দ ও শান্তির ফসলে। ফসল পাহারা দেন শুকদেব, অবিরত হরিনাম নিক্ষেপ করেন তিনি আর পাপরূপ পাখীরা দূরে পালিয়ে যায়। 

একনাথ বলতেন ভক্তি সাধনই হল  ঈশ্বর লাভের প্রশস্ত রাজকীয় পথ, তিনি কখনও জাতি বলে ভেদ করেন নি। তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ,শূদ্র সকলেই সমান। এভাবেই তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন চন্ডালও শ্রেষ্ঠ, যদি সে প্রেম ভরে ঈশ্বর ভজন করে আর ব্রাহ্মণ ও ব্যর্থ যদি সে হরির চরণ কমল না পায়। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে সাধক একনাথ মানব লীলা সংবরণ করেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...