দ্বিতীয় প্রজন্মের ফেলু গড়ে উঠল ফেলু স্রষ্টার দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে

ফেলুদা আমাদের কৈশোরের আবেগ। সন্দেশের পাতায় সেই গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফেলুর আত্মপ্রকাশ। তারপর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। আজও সমানভাবেই জনপ্রিয় ফেলু কাহিনী। সত্যজিৎ নিজেও বলেছিলেন সন্দেশের পাতা ভরাতে তাঁর কলম ধরা। ভাগ্যিস ধরে ছিলেন, নয়ত ফেলুর মতো এমন এক দাদাকে পেত না বাংলা সাহিত্য। কেবল লিখেই নয়, বইয়ের পাতা থেকে পর্দাতেও ফেলুদাকে এনেছিলেন সত্যজিৎ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত আর সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকে নিয়ে সুদূর মরুভূমিতে ড: হাজারাদের পিছনে ধাওয়া করা। মুকুলের সোনার কেল্লার সন্ধান করা। তারপর বানালেন জয়বাবা ফেলুনাথ। ঘোষাল বাড়ির গণপতি নিয়ে গপ্পো। সাথে দুর্ধর্ষ ভিলেন মগনলাল মেঘরাজ। এরপর সন্তোষ চলে গেলেন, সত্যজিৎও দিলেন পাড়ি। তবে সন্তোষ চলে যাওয়ার পর সত্যজিৎকে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন আপনি তো ফেলুদা করতে পারেন আবার। সে তখন সদ্য নাটক করছে জোছন দস্তিদারের অধীনে তৈরি হচ্ছে। সত্যজিৎ বলেছিলেন সন্তোষ নেই আমি আর ফেলু করব না। কে জটায়ু হবে? আর ফেলুই বা কে করবে? জটায়ুর জায়গায় রবি ঘোষের কথা বলে সে বলেছিল ফেলু সে নিজেই করবে। রবি ঘোষকে দিয়ে জটায়ু হবে না, তবে তুমি আমার ছেলে বাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারো ও ফেলু করতে পারে। আরেকবার এক বিয়ে বাড়ির কথা সত্যজিৎ এক ছেলেকে দেখে বললেন তুমি ভাল তোপসে হতে পারতেন। ছেলেটি দুম করে বলে দিল আপনি তো আর করবেন না! মানিক বাবুর সেই একই উত্তর কী করে করব সন্তোষ নেই। পরে সেই দুজনকেই ফেলু নতুন করে বুনলেন সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়। 
 
দুজনকে চিনতে পারলেন না? দুজন হলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। আমাদের ফেলু আর তোপসে। সত্যজিতের অসুস্থতার বাড়িতেই চাপ বেড়েছিল সন্দীপের উপর। পুরোপুরি ক্যামেরা অপরেট করতে হত। সত্যজিৎ তখন ভগ্ন শরীরে, তৈরি হল আরেক ফেলুদা হিন্দিতে। কিসসা কাঠমান্ডু কা। শশী কাপুর, অলংকার যোশী আর মোহন আগাসে হলেন ত্রয়ী। যদিও দর্শক সে ফেলুকে খুব একটা পছন্দ করেনি। এবার বাংলায় ফেলুর পালা। ততদিনে সত্যজিৎ চলে গিয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর, বাবার চিত্রনাট্যে ভালভাবেই উত্তরণ উতরে দিয়েছিলেন সন্দীপ। সন্দীপ বানালেন বাক্স রহস্য, সেই ঠিক হওয়া ত্রিগল সব্যসাচী, শাশ্বত আর রবি ঘোষ। দর্শক ফিরে পেল ফেলুদা। তারপর এগোতে থাকল ফেলু সিরিজ, টিভির জন্যেই বানালেন সন্দীপ। একে একে তৈরি হল গোসাঁইপুর সরগরম, যত কান্ড কাঠমান্ডু, ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা, গোলাপি মুক্ত রহস্য অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য। ততদিনে রবি ঘোষ, অনুপ কুমারের পর জটায়ু হলেন বিভু ভট্টাচার্য। তারপর বড় পর্দার পালা এলে বোম্বাইয়ের বোম্বেট। ফেলু জটায়ু একই রইলেন বদল হল তোপসে। পরমুব্রত চট্টোপাধ্যায় হলেন নয়া তোপসে। 
 
এরপর ফেলু ফ্রাঞ্চাইজিকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি, ত্রয়ীকে অপরিবর্তিত রেখে তৈরি হল কৈলাসে কেলেঙ্কারি, টিন টরেটোর যীশু। চূড়ান্তভাবে সফল হল ফেলু সিরিজ। তারপর ফের তোপসে বদল গোরস্থানে সাবধান আর রয়াল বেঙ্গল রসহ্যে তোপসে করলেন সাহেব ভট্টাচার্য। সব্যসাচীও ফেলু থেকে সরে এলেন। বাদশাহী আংটি বানালেন সন্দীপ। আবির ফেলুর ভূমিকায় আর সৌরভ তোপসে, জটায়ু ছাড়াই এগোলেন। প্রথম দিকের গল্প তাই তখনও জটায়ুকে গপ্পে আনেন নিই সত্যজিৎ। ছাপ ফেলতে পারল না ছবি। তাই অগ্যতা ফিরলেন সব্যসাচী ও সাহেব জুটি। তৈরি হল ডবল ফেলুদা। দুটি গল্প গোলোকধাম রহস্য আর সমাদ্দারের চাবি। ডবল ফেলুদা করে সব্যসাচী চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর ফেলু হবেন না। ভারী দুঃখ হয়। ফেলুপ্রেমীদের কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মিটল, বড় পর্দায় না এলেও সিরিজে এলেন ফেলু। এক নয় একাধিক ফেলুকে পেল বাঙালি। তবে আবার ফেলু নিয়ে ফিরছেন সন্দীপ রায়। সকলের বাবুদা এবার বেছেছেন হত্যাপুরি গল্পকে। ইন্দ্রনীল হচ্ছেন ফেলু। নতুন ছবির দিকে তাকিয়ে আপামর ফেলুপ্রেমীরা। 
 
তবে আমাদের প্রজন্ম তথা একবিংশ শতকের প্রথম দশকের ছেলে মেয়েরা বইপড়ার চেয়েও বেশি ফেলুকে দেখে চিনেছেন। সেই ফেলু হলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী আর সেই ফেলুর স্রষ্টা হলেন সন্দীপ রায়। দ্বিতীয় প্রজন্মের ফেলু গড়ে উঠল ফেলুর স্রষ্টার দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে। উত্তরাধিকার মিশে আছে সেই সৃষ্টিতে। আর ৮ সেপ্টেম্বর তারিখটি সমাপতনে মিলিয়ে দিল সন্দীপ সব্যসাচীকে। আজ দুজনেরই জন্মদিন। দ্বিতীয় প্রজন্মের ফেলু রূপকারদের জন্মদিন শুভ হোক। ভাল থাকুন সন্দীপ রায় ও সব্যসাচী চক্রবর্তী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...