অবিভক্ত বর্ধমান হল বাংলার অন্যতম প্রাচীন কালীক্ষেত্র। বিশালাকার কালীর আরাধনার জন্য প্রসিদ্ধ পূর্ব বর্ধমান। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার মুস্থূলী গ্রামে পূজিতা হন দেবী কালী। দেবীর নাম মা বোলতলা কালী। প্রায় তিনশো বছর ধরে চলে আসছে বোলতলা কালীর পুজো। কথিত আছে, বহু বছর আগে কোনও এক সাধক একটি বকুল গাছের নীচে ছোট মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে কালীর পুজো শুরু করেন। দেবী কালিকাই ছিলেন তাঁর আরাধ্যা দেবী। পরে ভক্তদের অনুদানে দেবীর মন্দির তৈরি হয়। সাধকের মৃত্যুর পর প্রথম প্রথম স্থানীয় জমিদাররা বেশ কিছুদিন পুজো করেছিলেন। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দা জনৈকা রানি দাস পুজোর দায়িত্ব পান। রানি দাসের উত্তরসূরিরা চার পুরুষ ধরে পুজো করছেন। বর্তমানে এটি বারোয়ারি পুজোয় পরিণত হয়েছে। পুজো কমিটির একটি ট্রাস্টও গঠন করা হয়েছে। ওই ট্রাস্ট কয়েক ধরে পুজো পরিচালনা করছে। এখন গ্রামবাসীরা এই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধকের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী মন্দিরের কাছেই সমাধিস্থ করা হয়েছে তাঁকে। সাধকের প্রতিষ্ঠিত বকুলতলার কালী থেকেই বোলতলা কালী নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়।
বোলতলার দেবী কালী মেজঠাকরুন নামেও পরিচিত। দীপান্বিতা অমাবস্যায় মেজঠাকরুনের পুজোর দিন দুপুরে এলাকার মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। পুজো শুরু হয় রাত ১২টার পর। পুজোর দিন রাতেই প্রতিমায় রঙের প্রলেপ পড়ে, মা সেজে ওঠেন। পুজো হয় তন্ত্রমতে। পুজোয় আজও বলিদান হয়, প্রচুর ছাগ বলি হয়। পুজোর দিনে প্রায় ৮০-১০০টি ছাগ বলি হয় এখানে। তিনশো বছর ধরে প্রাচীন সব নিয়ম মেনেই আজও পুজো হয়। মা বোলতলা কালীর পুজো উপলক্ষ্যে সমবেত হয় মুস্থূলীর আশেপাশের পাঁচ গ্রামের মানুষ।
প্রায় ৩০০ বছরের রীতি মেনে পুজোর দিন সকাল থেকে ঠাকুরের রঙ করা শুরু হয়। মাঝরাতে চক্ষুদানের পর মাকে মূল বেদীতে স্থাপন করা হয়। বিকাল থেকে গ্রামের বিবাহিত মহিলারা পান কলা দিয়ে মাকে পুজো দিতে আসেন।
ঘোড়ানাশ, মুস্থূলী, আমডাঙা ও একড়েলা গ্রামের গৃহবধূরা দল বেঁধে কালীপুজোর দিন দুপুরে বোলতলা মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হন। হেতু সিদুঁর খেলা। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে সেই সিদুঁর খেলার নাম ‘এয়োতি বরণ’ বা ‘ঠারোগো পান’। দেবীকে পান, সুপারি, কলা দিয়ে বরণ করার পর দু’-তিন ঘণ্টা ধরে চলে সিদুঁর খেলা। রাত বারোটার মাঝরাতে মায়ের পুজো শুরু হয়। পরদিন ভোর পর্যন্ত নানা রীতি মেনে পুজো হয়। দেবীর গায়ে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার পরানো হয়। সারা বছর ব্যাঙ্কের লকারে দেবীর গয়না রাখা থাকে। পুজোর সময় তা নিয়ে এসে দেবীর মূর্তিতে পরানো হয়। দেবীর উচ্চতা প্রায় ১১ ফুট। দেবীর পদতলে শায়িত থাকেন শিব।
কাটোয়ার মুস্থূলী গ্রামের বোলতলা কালীর পুজোর প্রধান আকর্ষণ হল বিসর্জন। এখানে বিসর্জন হয় বিশেষ রীতিতে। বিসর্জনের সময় মন্দির থেকে মাতৃ প্রতিমা বার করার পরই গ্রামের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এলাকাবাসীর হাতে জ্বলে ওঠে পাটকাঠির মশাল। কাঁধে তুলে নেওয়া হয় দেবীকে। তারপরই দেবীকে কাঁধে নিয়ে শুরু হয় দৌড়। দেবীর সঙ্গে ছুটতে থাকে সারি সারি মশাল। চলে দেবীর জয়ধ্বনি। হেঁটে হেঁটে নিয়ে যাওয়া যায় না দেবীকে, কাঁধে প্রতিমা নিয়ে ছোটাই এই পুজোর রেওয়াজ। প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় পাশের গ্রাম আমডাঙায়। সেখানে আছেন বুড়ো শিব। তাঁর সঙ্গে দেখা করেন দেবী। দেখা করার পর্ব মিটলে, দৌড়ে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় দেবীকে। পরে মন্দিরের পাশের একটি পুকুরে বিসর্জন করা হয় প্রতিমা। প্রতিমা বিসর্জনের সময় বেহারা ঠিক করতে হয় না। দেবীর মূর্তিকে কাঁধে নেওয়ার জন্য বাসিন্দাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। বিসর্জন দেখতে রাস্তার দু'ধারে হাজার হাজার মানুষের ভিড় উপচে পড়ে।