সাহিত্য-আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র: সমরেশ মজুমদার

তাঁর ইচ্ছে ছিল নাটক লিখবেন এবং অভিনয় করবেন। কস্মিনকালেও লেখক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার বোধহয় অন্যরকম ইচ্ছে ছিল। তাই হয়ে গেলেন বাংলার জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকদের একজন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশেও তাঁর জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত।

তাঁর অনিমেষ ট্রিলজি পড়েননি, পড়ে মাধবীলতাকে ভালবাসেননি এমন বাঙালি পাঠক বোধহয় পাওয়া যাবে না। শুধু ভারতে নন, আমেরিকাতেও প্রবাসী সাহিত্যপ্রেমী বাংলাদেশী বা ভারতীয় বাঙালিদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। যারা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী বা গোয়েন্দা কাহিনী পছন্দ করেন তাদের কাছেও এই সাহিত্যিক সৃষ্ট "অর্জুন" খুব পরিচিত একটি চরিত্র। তাঁর নাম আমরা সবাই জানি। সমরেশ মজুমদার... বাংলা সাহিত্য জগতের এক অবিস্মরণীয় অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র।

Samaresh-Majumdar1

আজ বরং তাঁর লেখক হওয়ার গল্পটা বলি। সেটা ১৯৬৭ সাল। তখন তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে ভর্তি হয়েছেন। খুব ইচ্ছে নাটক করবেন। কিন্তু অন্য নাট্যকারের লেখা নাটকে অভিনয় করতে তাঁর অত ভাল লাগে না। সাধ হল নিজেই নাটক লিখবেন। লিখেও ফেললেন।

কিন্তু সেই নাটক বন্ধু বান্ধব কারুর পছন্দ হল না। তখন বন্ধুরা তাঁকে পরামর্শ দিল একটা গল্প লিখতে যেটাকে নাট্যরূপ দেওয়া হবে। লিখলেন গল্প। সেটাও নাটক হিসেবে কারুর পছন্দ হল না কিন্তু গল্প হিসেবে সবার ভাল লাগল। বন্ধুরা বলল কোনো পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতে।

Samaresh-Majumdar2

সমরেশ মজুমদার সেই গল্পটি পাঠিয়ে দিলেন দেশ পত্রিকায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল কিন্তু গল্প আর ছাপা হয় না তখন সমরেশ বাবু গেলেন দেশ পত্রিকার অফিসে। দেখা করলেন বিমল করের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার যোগাযোগের পর বিমল কর আশ্বাস দিয়েছিলেন যে গল্পটা পরের সপ্তাহে ছাপা হবে। আশ্বাস পেয়ে খুশিতে বন্ধুদের নিয়ে কফি হাউসে খাইয়েছিলেন। কিন্তু পরের সংখ্যায় সেটি ছাপা হয়নি।

রাগ করে সমরেশ বাবু এরপর পাবলিক ফোন থেকে দেশ পত্রিকার তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান বিমল করকে কল করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। পরে অবশ্য দেশ পত্রিকায় গল্পটি ছাপা হয়। ১৫ টাকা সম্মান-দক্ষিণা পেয়ে সেটা দিয়েও বন্ধুদের কফি হাউসে খাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা তাঁকে আবারও লিখতে বলেন। বন্ধুদের সেই কফি ও পাকৌরা খাওয়ার লোভ থেকেই তাঁকে বারবার অনুরোধ এবং তাতে পরপর গল্প লিখতে থাকা ও সেইসময়ের বিখ্যাত সব পত্রিকায় সেই গল্পগুলো প্রকাশিত হওয়া

Samaresh-Majumdar3

... বাংলা সাহিত্যজগতে সাহিত‌্যিক হিসেবে পদার্পণ করলেন সমরেশ মজুমদার। জন্ম হল এক উজ্জ্বল সাহিত্য নক্ষত্রের। ১৯৭৫-এ প্রকাশিত হল প্রথম উপন্যাস "দৌড়"... এরপর শুধুই এগিয়ে চলা।

তাঁর বিখ্যাততম উপন্যাসত্রয়ী উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লেখেননি। বলা যেতে পারে, বাধ্য হয়েই লিখেছেন। অথচ আজও সম্ভবত সেই 'জোর করে লেখা' দ্বিতীয় উপন্যাসটি তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয় যার নাম "কালবেলা"।

"উত্তরাধিকার" যখন শেষ হয়েছিল তখন হাজার হাজার পাঠক দেশ পত্রিকায় চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছিলেন পরের পর্ব লেখার জন্য। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের অনুরোধে তিনি "কালবেলা" লিখতে শুরু করেন। আর এই কালবেলা উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলেন "সাহিত্য আকাদেমি" পুরস্কার।

Samaresh-Majumdar4

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল "সাতকাহন"। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র "দীপাবলি" নামে একটি কিশোরী মেয়ে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন সাতকাহন-এর দীপাবলির কথাও। বলেছিলেন তাঁর এক প্রতিবেশীর বারো বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের আট দিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে আসে। এবং সমরেশ বাবুকে সেই মেয়েটি বলেছিল "কাকু, আমি বিধবা হয়ে বেঁচে গেলাম। এখন আমি খুব খুশি"...এই ঘটনা থেকেই দীপাবলি চরিত্রটি এবং সাতকাহন উপন্যাস তৈরি হয়েছিল।

১৯৪৪ সালের মার্চেই জন্ম হয়েছিল এই অতি বিখ্যাত সাহিত্যিকের। ছেলেবেলা কেটেছে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে। বড় হয়ে পড়েছেন স্কটিশ চার্চ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাসগুলি এবং বহু ছোটগল্প কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পাঠককে মুগ্ধ করেছে, করছে ও অনুপ্রাণিত করেছে। কয়েক বছর আগে সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় তাঁর সম্পূর্ণ স্মৃতি ফিরে আসে এবং তিনিও ফিরে আসেন সাহিত্য জগতে স্বমহিমায়। ঈশ্বরের কাছে তাঁর দীর্ঘায়ু এবং আরো দীর্ঘ সাহিত্য জীবন কামনা করি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...