সুরের বিপ্লবী সলিল চৌধুরী

তাঁর নাম জলের সমার্থক শব্দ, আর চিন্তা- চেতনা, মননে আর কর্মে তিনিও ছিলেন ঠিক জলের মতোই অবাধ। জল যেমন নির্দিষ্ট আকারহীন,বর্ণহীন- বিশ্বের সব প্রান্তেই যেমন তার অবাধ স্রোত- সেরকমই সঙ্গীত দুনিয়ায় সলিল চৌধুরীর বিচরণও পার করেছে দেশ,কাল, সীমানার গন্ডী। আশৈশব বিশ্ব সুরের ভুবনে ভ্রমণ করতে করতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংগীত জগতের বিশ্ব নাগরিক।

1_7G7hQxRwg-HcIWC8bDtBqg
আসামে (অধুনা অসম) এক সঙ্গীতপ্রেমী পরিবারে জন্ম হয় সলিল চৌধুরীর। তাঁর বাবা শ্রী জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরীর পেশা চিকিৎসা হলেও তাঁর নেশা ছিল সঙ্গীত সাধনা। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল। ফলে শৈশবেই তাঁর আলাপ হয় মোজার্ট,বেথোফেন, সিম্ফনির বিরাট সম্ভারের সঙ্গে। পাশাপাশি, আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে এক অসমবয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে শিশু সলিলের। আসামের চা বাগান ছিল নানা ভাষা নানা মতের মিলন ক্ষেত্র, সেখানে শ্রমিকরা আসতেন সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফলে সেই ছোট্ট বয়সেই ভারতের বিভিন্ন জায়গার আঞ্চলিক গানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন ছোট্ট সলিল।
680e411a380c602a94c2c27ccdf2d34b
একটু বড় হলে পড়াশোনার জন্য তিনি চলে আসেন কলকাতায় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে। সেখানে তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরীর সঙ্গে শুরু হয় তাঁর সঙ্গীতচর্চা। তাঁর পিয়ানো, তবলা, বাঁশি, এস্রাজ ,গিটার প্রভৃতি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখার হাতেখড়ি এই ছোটদার কাছেই। সঙ্গীতমনস্ক ছোটভাই কে দাদা নিখিল চৌধুরী নিয়ে যেতেন এক আশ্চর্য দুনিয়ায়। সেসময় চলচ্চিত্র ছিল নির্বাক। প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় যখন সেই চলচ্চিত্র দেখানো হতো, তখন দৃশ্যে দেখানো পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য নেপথ্যে একদল মিউজিশিয়ান বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে সেই দৃশ্য উপযোগী সুর যন্ত্র বাজাতেন। দাদার হাত ধরে সেখানেই পৌঁছলেন সলিল। নিজেও গিটার বাজালেন তাদের সঙ্গে।

দেশ ভেসেছে বাণের জলে / ধান গিয়েছে মরে / কেমনে বলিব বন্ধু প্রাণের কথা তোরে...
ছাত্রাবস্থাতে বন্যাত্রাণের জন্য রচিত তাঁর এই গানের মাধ্যমেই জন্ম হয় গীতিকার সলিল চৌধুরীর। পরবর্তী কালে যার লেখা গণসঙ্গীত হয়ে উঠবে বিপ্লবের সাঙ্গীতিক মাধ্যম তাঁর সূচনা তো এমন হবেই। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মনুষ্যসৃষ্ট ভয়াবহ মন্বন্তর বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। মানুষের এতদিনের মূল্যবোধ, চিন্তা-ভাবনা কে সমূলে নাড়িয়ে দিল এই মন্বন্তর। মানবতার এই অবমূল্যায়নের দিনে স্হির থাকতে পারলেন না কোনো সংস্কৃতিমনস্ক মানুষই। সমকালীন গান, কবিতা, নাটক প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই উঠে এসেছে ভয়াবহতার জীবন্ত চিত্র।
তরুণ সলিল ছিলেন এই বিভীষিকার প্রত্যক্ষদর্শী। শহরের পথে দুর্ভিক্ষ পীড়িত এক কালো মেয়েকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে এ বোধহয় কোনো এক মেঘলা দিনে কবিগুরুর দেখা ময়নাপাড়ার মাঠের সেই কৃষ্ণকলি, আজ কাঠফাটা রোদে পরিস্থিতি তাকে নিয়ে এসেছে শহরের রূক্ষতায়। রচিত হয় –
হয়তো তাকে দেখেনি কেউ/ কিম্বা দেখেছিলেম...
মন্বন্তরপীড়িত গ্রামের মিউজিক্যাল ফটোগ্রাফ
কোনো এক গাঁয়ের বধূ গানটি‌।

Salil-Chowdhury (1)

সলিল চৌধুরীকে বাংলার সঙ্গীত বিপ্লবী বললে বোধহয় অত্যুক্তি হয় না। তেভাগা আন্দোলনের সময়ের হেঁই সামলো হেঁই হো, ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই সারা ভারতব্যাপী হরতালের জন্য রচিত ঢৈউ উঠছে কারা টুটছে, বন্দীমুক্তি আন্দোলনের জন্য লেখা বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা, বা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শান্তি সঙ্গীত হিসাবে পুরষ্কার প্রাপ্ত আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি এই গানগুলো আজও রক্ত গরম করে তোলে।

তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বম্বে ইয়ুথ কয়্যারের অনুপ্রেরণায় ১৯৫৮ সালে কলকাতায় সত্যজিৎ রায় আর সলিল চৌধুরীর অভিভাবকত্বে রুমা গুহ ঠাকুরতার নেতৃত্বে পথ চলা শুরু করে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার। পৃথিবীবিখ্যাত গান We shall overcome এর বাংলা তর্জমা আমরা করব জয় গানটিও তাঁর চিন্তা আর কলমের সন্তান।

১৯৪৯ সালে পরিবর্তন ছায়াছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান সলিল চৌধুরী। এরপর বাড়ি থেকে পালিয়ে, কিনু গোয়ালার গলি, লালপাথর, হারানের নাতজামাই প্রভৃতি আরও অনেক বাংলা ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে হিন্দী ছায়াছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেন, ছবির নাম দো বিঘা জমিন। এই ছবির জন্য প্রথমবা্য বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পান, ফলে এই সময় আরও কাছ থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলেন সলিল চৌধুরী। এছাড়াও জাগতে রহো, মুসাফির, হাফ টিকিট, আনন্দ, মৃগয়া প্রভৃতি হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। পাশাপাশি, অসমিয়া, ওড়িয়া, মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম এইসব প্রাদেশিক ভাষার ছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সাফল্যের সঙ্গে।

প্রেমের গানেও সলিল স্রোতে ভেসেছে আপামর ভারতবাসী। বাংলা গানের জগতে মান্না দে- র কন্ঠে বাজে গো বীণা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে পথ হারাবো বলেই এবার, বা আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা, লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে পা মা গা রে সা, আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে প্রভৃতি কালজয়ী গান আজও ঝড় তোলে সব বয়সের শ্রোতার হৃদয়ে। হিন্দিতেও ম্যায়নে তেরে লিয়ে, কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে, জিন্দেগি ক্যায়সে হ্যায় পহেলি এই গানগুলো আজও ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের।

ছোটদের গানের জগতেও সলিল স্রোত ছিল ছিল সমান ভাবে বহমান। তাঁর কথা ও সুরে তাঁরই কন্যা অন্তরা চৌধুরীর কন্ঠে বিখ্যাত বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে, ও সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ, এক রে ছিল মাছি বা ও আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে গানগুলো দোলা দিয়ে যায় শিশুদের মনে।
কোনো নির্দিষ্ট একটা বা দুটো ঘরাণা বাঁধ দিয়ে আটকাতে পারেনি সলিলের সঙ্গীত জোয়ারকে। তাঁর সুরে এসে মিশেছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর জল। ১৯৯৫ সালের আজকের তারিখেই পৃথিবীর বুক থেকে বাষ্পের মত মিশে যান সলিল চৌধুরী, শুধু রয়ে যায় তাঁর অমর সৃষ্টি গুলো। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি রইলো আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।


নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...