গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যখন ভক্ত দুঃখ দুর্দশার মধ্যে থাকবে, ধর্মের হানি হবে এবং অধর্মের বাড়বাড়ন্ত হবে,তখন তিনি আবির্ভূত হবেন তাঁর ভক্তদের উদ্ধার করতে। গীতার এই বাণী যেন সার্থক রূপ পেয়েছিল সন্ত সখুবাঈ-এর জীবনে। যেখানে ভক্তের দুঃখ দুর্দশা দেখে ভগবান আর থাকতে পারেন নি, তিনি শুধু যে ভক্তকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন তাই নয়, তিনি ভক্তের রূপ নিয়ে ভক্তের বাড়িতে এসে ভক্তের জায়গায় বন্দী হয়ে থেকেছিলেন ও নিজের ভক্তকে করেছিলেন মুক্ত। ভগবান ও ভক্তের এক অনন্য বন্ধন লক্ষ্য করা গিয়েছে সখুবাঈ-এর জীবনে। চলুন আজ জেনে নিই সেই সাধিকার জীবনী, অন্তরের বিশ্বাস ও আজন্মের দুঃখ কষ্টের বিনিময়ে যিনি নিজের আরাধ্যকে লাভ করেছিলেন নিজের গৃহের মধ্যে।
পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে পণঢরপুরের বিট্ঠল অত্যন্ত জাগ্রত এবং ভক্ত বৎসল। সখু বাঈও বাল্যকাল থেকেই তাঁর কথা শুনেছেন ও অন্তরে অন্তরে নিজেকে ভগবানের পাদপদ্মে সমর্পণ করে দিয়েছেন, কিন্তু কখনও সেই আরাধ্যকে দর্শন করতে পারেননি সখুবাঈ। তাই গৃহিণী সখুবাঈ ঘরের সকল কাজের মধ্যে সব সময় সেই আরাধ্যের কথা ভাবতেন, ভগবানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।
তার এইরকম আচরণ স্বামী শাশুড়ি ও অন্যান্য গুরুজনদের কাছে অমার্জনীয় অনাসৃষ্টি হিসেবে গণ্য হত। যার কারণে তাকে সহ্য করতে হত গঞ্জনা, ভর্ৎসনা ও কঠিন শাসন।
শ্বশুরবাড়িতে এমন অত্যাচার সহ্য করতে করতে, কোথাও কোনও স্নেহ ভালবাসার আশ্রয় না পেয়ে সখুবাঈ-এর সকল মন তীব্র বেগে ছুটে যেত সেই অসীম চিরাচরিতের দিকে। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ সেই আরাধ্যের ধ্যান করতেন তিনি আর এই ভাবেই অন্তরে অন্তরে সখু যেমন সাধিকা হয়ে উঠছিলেন তেমনি তার শ্বশুর বাড়ি হয়ে উঠছিল, তার জন্য কারাগৃহ।
এইরকম ভাবেই একদিন সখুবাঈ একাদশীর দিন একদল সাধুর সঙ্গে পণঢরপুর যাবেন বলে ঠিক করেন। সেই অনুযায়ী সকালবেলায় উঠে বাড়ির সব কাজ সেরে নেন, এত তাড়াতাড়ি
কাজ সারতে দেখে শাশুড়ির মনে সন্দেহ জাগে তিনি প্রশ্ন করেন বৌমাকে, সখু জানান, তিনি সাধুদের সাথে বিঠ্ঠল দেবের মন্দিরে যাবেন দর্শন করে এসে আবার বাড়িতে সব কাজ করে দেবেন! কোন কাজে তিনি কোন অসুবিধা হতে দেবেন না।- বাড়ির বউ কারোর কোন অনুমতির তোয়াক্কা না করে পর পুরুষের সাথে মন্দিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এত বড় আচরণ সহ্য হয় না শাশুড়ি মাতার , তিনি তৎক্ষণাৎ তার ছেলের সাথে পরামর্শ করে সখুকে ঘরের ভিতরে থামের সঙ্গে ভালো করে বেঁধে রাখেন, যাতে কোনভাবেই হতভাগিনী পালাতে না পারে!
সখু একা ঘরে বন্দিনী অবস্থায় কাঁদছিলেন, ঠিক সেই সময় এক অপরিচিতা রমণী তার কাছে আসেন আর বলেন, আমি তোমার বাঁধন খুলে দিচ্ছি, তুমি চলে যাও পনঢরপুর, এখনই পা চালিয়ে গেলে সাধুদের ধরতে পারবে আর যাবার আগে তোমার জায়গায় আমাকে বেঁধে রেখে যাও।
ভগবানকে দেখার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেননি সখু, কোন কিছু ভাবনা-চিন্তা না করি তিনি ওই অপরিচিতা রমণীকে তার জায়গায় বেঁধে দিয়ে কুলমর্যাদা ও নিজের মর্যাদা ভুলে ছুটে যান সাধু সঙ্গে ভগবানকে দর্শন করতে। অন্যদিকে পণঢরপুরে গিয়ে চির আরাধ্যের দর্শন করে সখু ভগবানের বন্দনা গানে মুখরিত হয়ে ওঠেন, সেখানে ভগবানের আরাধনাতেই তার সময় কাটছিলো, এমন সময় এক সাপ তাকে দংশন করে, অজ্ঞান হয়ে তিনি মন্দিরে পড়ে যান, তখনই একজন চিকিৎসক এসে তার চিকিৎসা করতে থাকেন।
অন্যদিকে সখুর স্বামী আর শাশুড়ি বাড়ি ফিরে এসে সখুকে বদ্ধ অবস্থাতে দেখে সামান্য কিছু ভৎসনা করার পরে মুক্তি দেন, তারা দেখেন তাদের বাড়ির বউ শাস্তি প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র কথা না বলে ভগবান দর্শন প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র কথা না বলে আগের মতো বাড়ির কাজে লেগে যায়।এতে তারা স্বাভাবিকভাবেই খুশি হন।
অন্যদিকে গ্রামের কিছু মানুষ পণঢরপুরে সখুকে দেখেছিলেন, তারা এসে সখুর শাশুড়িকে বলেন, তোমাদের বাড়ির বউ সাধুদের সঙ্গে পণঢরপুরে গেছে, তাকে সাপে কেটেছে, তার চিকিৎসা চলছে, যে বউ সারাদিন ঘরে কাজ করছে, সেই বউয়ের নামে এত বড় অপবাদ মানতে পারেন না শাশুড়ি, প্রতিবেশীদের কথা শুনিয়ে দেন তিনি, প্রতিবেশীরাও চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে সখুকে কর্মরতা দেখে স্বীকার করেন, হয়তো সখুর সাথে চেহারার সাদৃশ্য থাকা অপর কোন মহিলাকে তারা দেখেছেন।
অন্যদিকে নিজেদের বাড়ির বউ এর নামে এত বড় মিথ্যা অপবাদ শোনার পরে সখুর শাশুড়ি আর স্বামীর মনেও পরিবর্তন এলো,তারা বুঝতে পারলেন তাদের বাড়ির বউ ভালোই, তাদের সব কথাই শুনে চলে, শুধু শুধু পাড়া-প্রতিবেশীরা নিন্দা করে তাদের সম্পর্ক খারাপ করতে চায়।
অন্যদিকে সর্পদংশনের পর মন্দিরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন সখু, কিন্তু তখনও তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন নি, শারীরিক দুর্বলতার কারণে সেই দিন মন্দিরেই কাটান তিনি, এরপর সখুর বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। এতক্ষণে তার হুঁশ ফেরে প্রায় তিন দিন বাড়ির বাইরে আছে সে, বাড়িতে আর তার জায়গা হবে তো? আর অপরিচিতি যে মহিলা তার জন্য এত বড় কাজ করেছেন তারই বা কি হলো, নিজের সাথে সাথে ওই অপরিচিতার জীবনটিরও সর্বনাশ ঘটালেন এই ভেবে তিনি লজ্জায় মরে যেতে থাকেন! কিন্তু গ্রামের রাস্তায় কিছুদূর আসতেই তিনি দেখতে পান সেই অপরিচিতাকে, তার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে সুখ জানতে চান সকল কথা।
অপরিচিতা হেসে বলে,"না ভাই কোন অসুবিধা হয়নি। তোমার কলসি নিয়ে এসেছি আমি। তুমি জল নিয়ে যাও।" সখুর মনের বিস্ময় তখনও কাটেনা, প্রায় দুদিন ধরে তিনি নিখোঁজ এই দুদিন ধরে অপরিচিতা মহিলা তার শ্বশুরবাড়িতে তার পরিচয় নিয়ে রয়েছে, তার স্বামী শাশুড়ি ধরতেই পারেননি সত্যিটা! এ কিভাবে সম্ভব! তখনই সখুর কাতর মিনতিতে সেই অপরিচিতা তাঁর আসল রূপ দেখান! সখু দেখেন এই অপরিচিতা আর কেউ নয় তার করুণাময় তার আরাধ্য বিঠ্ঠলদেব! এরপর সখু ফিরে গিয়েছিলেন নিজের সংসারে
নিজের স্বামী গৃহে, ভগবানের পাদ পদ্মে সেই ঘরই হয়ে উঠেছিল তার কাছে একান্ত নির্ভরতার জায়গা অপরদিকে ভগবানের অলৌকিক লীলায় এরপর থেকে শ্বশুরবাড়িতে আর কখনো কোনো অশান্তি হয় নি, তার স্বামী আর শাশুড়ি হয়ে উঠেছিলেন তার একান্ত গুণগ্রাহী।
আসলে ভগবান তো ভক্তেরই, যুগে যুগে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে কোন একটি হৃদয় ভগবানের নামে মুখরিত হয় আর সেই প্রেমে কাতর কৃষ্ণ তার ভক্তের আহ্বানে সাড়া দেন। সখুবাঈয়ের জীবন আমাদের শেখায় গীতার সেই অমূল্য বাণী, যেখানে ভগবান নিজে প্রতিশ্রুত হয়েছেন ভক্তের সঙ্গে তিনি সর্বক্ষণ আছেন, সখু বাঈয়ের জীবন যেন গীতার সেই বাণীর সাক্ষাৎ উদাহরণ।