"স্মৃতির খেয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। কোথায় কখন পাড়ি দিচ্ছি তার ঠিকানা নেই। বেপরোয়া হয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছি দিক সম্বন্ধে খেয়ালশূন্য হয়ে। মন নোঙর বাঁধল এসে প্রথম জীবনের ঘাটে। চলে গেলাম 'সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি'-তারই মাঝে, সেইখানে বিচরণ করছি। বিস্মৃতপ্রায় টুকরো টুকরো কত কথা, কত ঘটনার রঙিন ছবিগুলি সব একে একে উজ্জ্বল হয়ে এসে সামনে জ্বলজ্বল করছে। কিসের যেন সাড়া পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, পাতালের ঘুমন্তপুরী জেগে উঠেছে। দেখছি--কালের আবর্তনে যে জীবন বিলীন হয়ে গেছে অতীতের মাঝে, সেই অতীত-জীবন কেমন করে সামনে এগিয়ে আসছে, কেমন করে সেকাল একালের মধ্যে প্রবেশ করছে। বিগত যে জীবন, বাস্তবে যার অস্তিত্ব আর নেই, তাকে দেখতে পাচ্ছি স্মৃতির রাজ্যে। স্মৃতি তাকে কাছে এনে দিচ্ছে, দিচ্ছে তার স্পর্শ। বেশ ঘোরের মধ্যে রয়েছি যেন কিসের একটা সঙ্গে যোগস্থাপনা করে।" (সাহানা দেবী ‘স্মৃতির খেয়া’)
সাহানা দেবীর আত্মকথা-'স্মৃতির খেয়া'র একেবারে শুরুর এই কথা গুলোই তো আমার এই লেখার আদর্শ সূচনা হওয়ার, কারণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনিও তাঁর আত্মকথা লিখতে গিয়ে একই অনুভূতির হিন্দোলে অনুরণিত হয়েছিলেন; আমিও হলাম। 'টাইম ট্রাভেল'-এর অনুভূতি, ফিরে তাকানোর হিন্দোল, সেকালের সঙ্গে একালের অনুরনণ। বিবর্তন ও সময় নিরীক্ষায় বর্তমানের কাজ হল অতীতকে জাগিয়ে রাখা, ইতিহাসকে প্রানবন্ত করে তোলা। সাহানা দেবী এ সময়ের কাছে একজন 'অতীত'। সেই অতীতের দিকেই যদি আমরা ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তাঁর জীবনলগ্নের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের এই বর্তমান, যাকে বলে 'পূর্বাপর' সম্বন্ধ।
১৮৯৭ সালের ১৭ মে, জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রখরতায় বাংলাদেশে উদ্ভূত এক ভূমিকম্পের কিছুদিন আগে ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নেন সাহানা দেবী। 'সম্ভ্রান্ত' কারণ- তাঁর বাবা প্যারিমোহন গুপ্ত ছিলেন নামজাদা চিকিৎসক। ডিস্ট্রিক্ট সিভিল সার্জেন। পিতামহ জমিদার কালীনারায়ণ ব্রাহ্ম সমাজের মুখ্য ব্যক্তি। জ্যাঠামশাই কে জি গুপ্ত দুঁদে আইসিএস। বড়মামা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। মাসি অমলা দাশ এইচএমভি-র প্রথম মহিলা সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর আগে গৃহস্থ পরিবারের কোনও মহিলা গানের রেকর্ড করেননি। পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদ সেন। পিসতুতো ভগ্নীপতি সুকুমার রায়। এইরকম নক্ষত্রপরিবেষ্টিত পরিবারের তিনিও ছিলেন এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র।
আমরা যদি তাঁর সময়ের দিকে তাকাই, দেখতে পাব কঠিন সময়ের অন্ধকারে ডুবে না থেকে একজন মহিলা হিসেবে--সর্বপরি একজন মানুষ হিসেবে তিনি সার্বিক কল্যানে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন স্ফুলিঙ্গের মতো। সাহানা দেবী মানে সুরের রাগ-রাগিনী, রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদী অথবা দ্বিজেন্দ্রগীতি তো বটেই, পারিবারের মুক্ত শিক্ষা-চিন্তা তাঁকে যুক্ত করেছিল নিজের দেশের পীড়িত স্নায়ুর সঙ্গে; দশের কথা ভেবে নিজেকে টেনে এনেছিলেন স্বদেশ-স্বাধীনতা বিপ্লবের সক্রিয় অংশগ্রহনে। 'স্মৃতির খেয়া'-তে তিনি লিখেছেন- "...কখনও দেখি এসে দাঁড়িয়েছি মামার বাড়ির আঙিনায়, যে বাড়িতে বড় হয়েছি, মানুষ হয়েছি। যেখানে দেখেছি উদারতার, ত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত কত। দেখেছি বন্ধুর জন্যে জামীন হতে গিয়ে নিজেকে দেউললিয়া হতে। দেখেছি দেশের জন্যে সর্বস্ব দিয়ে নিঃস্ব হতে। আর দেখেছি স্বাধীনতা-সংগ্রামে জীবনকে পণ করে মরণকে তুচ্ছ করতে। বিশাল অন্তঃকরণ ছিল যাঁদের পরিচয়, যাঁদের কাছে অর্থ ছিল অর্থশূন্য, বিত্ত ছিল পায়ের ভৃত্য, সেই মামাবাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে আছি।"
এই মামাবাড়িতেই সাহানা দেবীর শৈশবকাল কাটে। তাঁর যখন দেড় বছর বয়স, মারা যান তাঁর বাবা প্যারিমোহন গুপ্ত। তখন তাঁরা চার বোন এক ভাই। মা অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর বাবার মৃত্যুর দু'মাস পরে জন্মায় তাঁর ছোট বোন। এহেন অবস্থায় মাত্র তিরিশ বছর বয়সে তাঁর মা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের নিয়ে এক অকূলপাথারে পড়েছিলেন। প্যারিমোহন নাকি মৃত্যুর আগে তাঁর মামা চিত্তরঞ্জনকে (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ) ডেকে তার হাতে তাঁর মাকে সঁপে দিয়ে বলে যান- "চিত্ত, এরা রইল, দেখো।"; অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়ে সন্তান সন্ততি নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে ওঠায় সবসময়ই একটা বেদনা আর অস্বস্তির মধ্যে থাকতেন সাহানা দেবীর মা। কারণ যে সময় এসব ঘটছিল সেসময় তাঁর দাদু দেউলিয়া, মামা চিত্তরঞ্জনের অবস্থাও করুণ, রোজগার নেই, সংগ্রাম করছেন; এসব দেখে তাঁর মা ভাইকে বলেছিলেন- "চিত্ত, আমি তোর কতই নিচ্ছি।" অন্যদিকে তাঁর মায়ের সব বেদনা নিজের অন্তরে তুলে নিয়ে, পরম মমতায় মামাবাবুও তাঁর মাকে বলেন- "দিদি, তোমার সঙ্গে আমার টাকার সম্বন্ধ! প্যারীবাবু কি সেই সম্বন্ধ রেখে গেছেন!" এমনভাবেই তাঁর জীবনের সঙ্গে অতপ্রতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল 'মামাবাড়ি'।
তিনি যাই করতেন সকিছুতেই যেন পরিশেষে গেয়ে উঠত তাঁর বিদগ্ধ হৃদয়। সুর-লয়-গান এত ভালবাসতেন যে একবার শুরু করলে একশো-দেড়শো গান নিমগ্ন হয়ে গেয়ে ফেলতেন। ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম রাখা হয়েছিল 'ঝুনুবাঈ' এবং 'বম্বেমেল', প্রথমটি আদরের তা বোঝা গেলেও দ্বিতীয় নামটির যে আলাদা ব্যখ্যা রয়েছে তা বোঝা যায়। 'বম্বেমেল' নামের কারণ, তিনি নাকি ছোট বেলায় এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে কথা বলে যেতে পারতেন, তাই তাঁর দাদু মজা করেই রাখেন এ নাম। 'গুরু-শিষ্যা' ছাড়াও সাহানা দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে রয়েছেন গাঢ় স্নেহের বাঁধনে; সাহানা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় স্নেহের 'ঝুনু'। শান্তিনিকেতনে ছিলেন সকলের প্রিয় ‘ঝুনুদি’। শুরুতে মাসি অমলা দাশের কাছে গান শেখা, পরে তাঁর যখন বারো বছর বয়েস সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নেন এবং তাঁর প্রতিভা-মন-চেতনার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে রবীন্দ্রনাথ-শ্রী অরবিন্দের সান্নিধ্যে এসে। গানে শিখেছিলেন দাদা অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপ রায়ের কাছেও। পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদকে তাঁরা ডাকতেন ‘ভাইদা’ বলে। অতুলপ্রসাদের কাছে প্রথম বারেই তিনটি গান শিখেছিলেন তিনি। তখন দার্জিলিংয়ে বড় মেসোমশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন সাহানা। অতুলপ্রসাদও সেই সময়ে ওই বাড়িতে উঠেছিলেন। সাহানা তাঁর কাছে প্রথমে শেখেন ‘তব পারে কেমনে যাব হরি’। তার পরে ‘বঁধু ধর ধর মালা ধর’ এবং ‘এ মধুর রাতে বল কে বীণা বাজায়’। সে সময় রবীন্দ্রনাথও ছিলেন দার্জিলিংয়ে। ভাইদা'র সঙ্গে সাহানা দেবী এক দিন যান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কথাবার্তার ফাঁকে সাহানাকে ইঙ্গিত করে অতুলপ্রসাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ জানতে চান, ‘‘গানে অনুরাগ কী বলে? গাইছে আজকাল?’’ অতুলপ্রসাদ জবাব দেন, ‘‘গানে অনুরাগ তো খুবই দেখছি। উৎসাহের শেষ নেই।’’ রসিক রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, ‘‘এখনও তো বিয়ে হয়নি। মেয়েদের হয় বিয়ে, নয় গান। দুটোর মাঝামাঝি কিছু নেই।’’
১৯১৬ সালে চিকিৎসক বিজয় বসুর সঙ্গে বিয়ে হয় সাহানার। বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনই হয়ে উঠেছিল তাঁর আত্মনির্ভরতার জায়গা। শৈশবে বাবাকে কাছে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো এক জ্যোতির্ময়ের সান্নিধ্যে এসে পেয়েছিলেন একজন আদর্শ গুরু-পরম পিতাকে। তাঁর জীবনের আর এক গুরু-পিতা হলেন শ্রী অরবিন্দ। ১৯০৮-এ অরবিন্দকে সাহানা দেবী প্রথম দেখেছিলেন তাঁর মামা চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে। আলিপুর বোমার মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অরবিন্দ দেখা করতে গিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে, তিনি ছিলেন সেই ঐতিহাসিক মামলার আইনজীবী। ১৯২৬-এ অসুস্থ হয়ে পড়েন সাহানা দেবী। শান্তিনিকেতনে থাকতে চেয়ে চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর অসুস্থতা ক্রমশ টিবি রোগের আকার নেয়। তখনও, ১৯২৭ সালের গোড়ার দিকে, মাস তিনেক তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। পরে সেখান থেকেই নৈনিতালের কাছে এক স্যানেটোরিয়মে চলে যান। যাত্রাসঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহানা লখনউতে দাদা অতুলপ্রসাদের বাড়িতে ওঠেন এবং সেখান থেকে পরদিন স্যানেটোরিয়মে। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর একাকী আধ্যাত্মিক জীবন। জীবনের শেষের দিকে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় একা একা ঘুরে অবশেষে ১৯২৮-এর নভেম্বরে পৌঁছন পুদুচেরিতে, শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে। সেখানে শ্রী অরবিন্দের দর্শন ও আশীর্বাদ পান। মাদারের স্নেহ পান। আশ্রমের সেলাই বিভাগে কাজের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে। সেই থেকে আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। সর্বত্যাগিনী হয়ে তাঁর অন্তরের পরম সুরালোকে পাড়ি দিয়ে ১৯৯০ সালে চিরবিদায় নেন সাহানা দেবী।
গান ছিল তাঁর প্রান; এছাড়াও তাঁর জীবনে ছিল নানা দিক, জন্মকাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জীবন কাহিনী নিয়ে লিখেছেন আত্মকথা- 'স্মৃতির খেয়া', লিখেছেন বহু কবিতা, প্রবন্ধ, স্বরলিপি রচনা করেছেন বহু রবীন্দ্র সঙ্গীতের। 'বাহিরে ভুল হানবে যখন', 'এখনো গেল না আঁধার', 'আমার আঁধার ভালো' -প্রভৃতি রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁরই স্বরলিপিতে গাঁথা। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতার থেকে প্রথম অতুলপ্রসাদী গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে। সেকালের কলের গান এখনও দুর্লভ রেকর্ড হিসেবে মৃদুমন্দ রয়ে গিয়েছে একালের ‘ইন্টারনেট’-এ। তাঁর গান থেকে গেলও তাঁর চর্চা এ সময়ের বিচারে শুধুই ‘অতীত’।
তাঁর একান্ত অনুগামী- সংগীতজ্ঞ হিমঘ্ন রায়চৌধুরী বলেছেন, "সাহানা দেবী-যিনি জীবনের একতারায় বেঁধে নিয়েছেন এক অখণ্ড-অমিয় মহাজীবনের ত্যাগ-তপস্যা-ভক্তির মহাগীত, তপশ্চারিণী মীরার মতো। ...ব্যক্তি-পরিচয় আর ব্যক্তিত্ব এক নয়। যেমন এক নয় জীবন ও জীবিকা। গোলাপে কাঁটার মতো, দীপে আগুনের মতো, চাঁদে কলঙ্কের মতো--সাহানা দেবীর ব্যথা তাঁর একান্ত নিজস্ব--তাঁর গান সবার- গল্পের মতো, আলোর মতো- ও জ্যোৎস্নার মতোই বিশ্বজনীন, সার্বজনীন।" বাস্তবার্থে সত্যিই তিনি ছিলেন বিদগ্ধ প্রান, সুরের অন্ধপ্রেমী। 'সাহানা' অর্থ বসন্তের গোধুলি রাগ, আর 'সাহানা দেবী' অর্থ তাইই।