এমন একজন ব্যক্তিত্ব-কে নিয়ে আজকের এই লেখা, যাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে মাথা-মেরুদণ্ড-মন-ভাষা-চেতনা সবকিছুই যেন আরও আরও সতেজ-প্রানবন্ত-দৃঢ-শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেই অনন্য সংগ্রামী মানুষ, নাট্যকর্মী, কবি, চিত্রশিল্পী, রাজনৈতিককর্মী, সংগঠক- 'একজন' সফদর হাশমি।
দিল্লীতে ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল অর্থাৎ আজকের দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫-এ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করেন এবং ছাত্রাবস্থাতেই গভীর সমাজ-রাজনৈতিক সচেতনতা বোধ থেকে যোগ দেন ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে। পরে যুক্ত হন 'ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন'(গণনাট্য সংঘ)-এর সঙ্গে। ১৯৭৩-এ যখন দেশ উত্তপ্ত, সেই পরিস্থিতিতেই ক'জন মিলে গঠন করেন জননাট্য মঞ্চ 'জনম'।
দিল্লীতে পড়াশোনা শেষে কিছু সময় দিল্লীর জাকির হোসেন কলেজ এবং শ্রীনগর, গারওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রেস ইনফর্মেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৮৩ সালে তিনি সম্পূর্ণভাবে থিয়েটারে ও রাজনৈতিককর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কাদের জন্য, কী উপায়ে, কম সময়ে ও কম খরচে কার্যকরভাবে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা ও সংগ্রামে প্রতিক্রিয়া জানানো যায় এবং অবহেলিতদের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, তাদের সংগঠিত করবার কাজের সহযোগী হিসেবে পথ নাটককে এগিয়ে নিতে হয়-সফদর হাশমী তা তাঁর স্বল্প সময়ের জীবনে দেখিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা, অঙ্গীকার, বিপ্লবের ভাষা সবার মধ্যে জাগিয়ে তোলার অদম্য উদ্দীপনা মানুষের জন্য এক বিরল এবং অতিপ্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত।
১৯৮৮ সালের এপ্রিল মে মাসে উট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারকর্মী Eugene van Erven এর কাছে দেওয়া সফদর হাশমীর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ভারতের সংগঠিত গণনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন,
যে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমগ্র দেশ দখল করেছে এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তার থেকে নিজেদের মুক্ত করবার প্রয়োজন আমরা সবাই অনুভব করি। আমরা সবাই এমন আঙ্গিকে কাজ করতে চাই যার সঙ্গে জনগণ পরিচিত এবং যা জনগণ শতশত বছর ধরে নিজেদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি যদি ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিক ব্যবহার করতে যাই সেই আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, সামন্ত কাঠামো, এমনকি প্রাক সামন্ত কাঠামোর চিন্তাভাবনা সম্বলিত বিষয়বস্তুও চলে আসে। ঐতিহ্যবাহী ফর্মকে কাঁচি চালিয়ে তার বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রহণ করা যায় না। কেননা এ দু’টি অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক গণনাট্য শিল্পী একাজ অনেকখানি সাফল্যের সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের থিয়েটারে আমরাও অনেক গান ব্যবহার করি যেগুলো ঐতিহ্যগত ভঙ্গি বা সুরসমৃদ্ধ। কিন্তু তারপরও আমি দাবি করতে পারি না যে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক দিক থেকে এই প্রশ্নটির সমাধান হয়েছে। আরও উল্লেখ করবার মত বিষয় হচ্ছে যে,সরকারি আধা সরকারি এবং বিদেশী তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যাপক আকারে আমাদের ঐতিহ্যগত লোক ও পাহাড়ী শিল্পধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। ঐতিহ্যবাহী জিনিশ যখন নতুন করে বিকশিত হচ্ছে তখন একই সঙ্গে হাজাররকম পিছিয়ে পড়ার চিন্তাও তাঁর সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে।
থিয়েটার এবং সচেতনতা নিয়ে তিনি আরও বলেন,
বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে, ভারতীয় ভাব মানে হচ্ছে দেবদেবী, অগ্নি বা বুদ্ধ উপাসনা, তীরধনুক ইত্যাদি। কিন্তু আরও অনেকের সঙ্গে আমিও মনে করি যে, এসব জিনিশ থিয়েটারকে ভারতীয় সঠিক চরিত্র দান করবার চাইতে বেশি করে তাকে আরও পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। থিয়েটারকে এ থেকে মুক্ত করা জরুরি। এর মানে এটা নয় যে, আমরা ঐতিহ্যিক শিল্প মাধ্যমগুলো বর্জনের কথা বলছি। দু’ধারার ঐতিহ্য আছে বলে আমরা মনে করি। আসলে ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের একটি সমালোচনামূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। দেশের ক্ষমতাশীল মানুষেরা চায় যে আমরা ঐতিহ্যের প্রতি প্রাণহীন আনুগত্য প্রকাশ করি।
(তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি সংকলিত হয় সফদর হাশমী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘দ্য রাইট টু পারফর্ম : সিলেক্টেড রাইটিংস অব সফদর হাশমী’ গ্রন্থে)
তাঁর বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায়, তিনি কখনই ঐতিহ্যবিরোধী ছিলেন না, ঐতিহ্যকে নিজের ভাষায় প্রাসঙ্গিকভাবে সঙ্গে নিয়ে চলাতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সফদর বিশ্বাস করতেন, যদি ঐতিহ্য জীবন্ত হয়, যদি এটা আমার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে এটা এমনিই আমার সৃষ্টিশীল প্রকাশের মধ্যে একটা স্থান করে নেবে। আমাদের উচিত নিজেদের মতো কথা বলা।
নাটককে হাতিয়ার করে তিনি জনগণকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ, আলোড়িত ও সংগঠিত করছিলেন ঠিক তেমনভাবেই বিক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু করে তুলছিলেন একদল অনুচিত-বিরূপ-অসচেতন শ্রেনীকে, আর তারই ফলাফল তাঁর নির্মম হত্যাকান্ড। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি দিল্লীর কাছে শহীদাবাদে শ্রমিক এলাকায় ‘হল্লাবোল’ নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে তিনি একদল রাজনৈতিক গুণ্ডাবাহিনীর হাতে গুরুতর জখম হন এবং নিহত হন একজন শ্রমিক। ২ জানুয়ারি সফদরেরও মৃত্যু হয়।
তবে তাঁর সংগঠন 'জনম' শোকে পাথর হয়ে থাকে নি। তাঁর মৃত্যুর পরই 'জনম' তাঁর অসমাপ্ত নাটক সমাপ্ত করে। শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের যে ধারা সফদর শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, যার অপরাধে তাঁকে খুন হতে হয়, তাঁর মৃত্যু সেই ধারাকে আরও কয়েকগুন শক্তিশালী করে তোলে, তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন। যতদিন নৈরাজ্যের আস্ফালন থাকবে, ততদিন 'একজন' সফদর হাশমিও বেঁচে থাকবেন মানুষের জন্য।