"বর্ণে ছন্দে গন্ধে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
একি তব হরি খেলা"...
তাঁর হওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার রাজা, হয়ে গেলেন সুরের দুনিয়ার মুকুটহীন রাজা। "কে মাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া"... আজও এই গান তন্ন সুরের মায়ায় আমাদের দুলিয়ে দেয়। তাঁর গায়কীতে এমন একটা চৌম্বক গুণ ছিল যে সেই আকর্ষণে আজও শ্রোতাদের বাঁধা পড়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। গলার স্বর খুব ভরাট ছিল না, ছিল ঈষৎ আনুনাসিক অথচ এই কন্ঠস্বর নিয়েই তাঁর অনন্য গায়কী স্রোতাদের কাছে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের। অমন গায়নরীতি তাঁর আগে শ্রোতারা কখনো পাননি, তার পরেও নয়। তিনি.... শচীন দেব বর্মন.. কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী এবং সুরকার... এস ডি বর্মণ নামেই বিশেষ পরিচিত। গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের এবং সুরের আবেদন কিছুমাত্র লঘু হয়নি।
শচীন দেব বর্মনের জন্ম হয়েছিল কুমিল্লাতে, ত্রিপুরার রাজবংশের সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বাবা কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র বাস করতেন কুমিল্লাতে। সেখানেই রাজপ্রাসাদে তাঁর জন্ম হয় ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর। ছোট থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ তাঁর। কুমিল্লায় থাকার সময়ই গ্ৰাম বাংলার লোকসঙ্গীত, ভাটিয়ালি ইত্যাদি তাঁকে আকৃষ্ট করত।
"দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত আত্মকথায় তিনি নিজেই লিখেছিলেন “খতিয়ে দেখলে আমার এ জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনা গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লায়, যৌবনের উন্মত্ততা ভাগীরথীর তীরে কলকাতায় – যা জীবনে প্লাবন এনে দিয়েছিল এবং প্রৌঢ়ত্বের ছোঁয়া দিল আরব সাগর - এই মুম্বাইতে”।
পরবর্তী সময়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আব্দুল করিম খান, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা। ক্লাসিক্যাল মিউজিকে যার এমন দখল তিনি কিন্তু সুখ দেওয়ার সময় প্রাধান্য দিয়েছেন গাঁয়ের মেঠো সুরকে যা মানুষের প্রাণে দোলা দিয়ে যায়।
রাজপরিবারের ছেলে হওয়ায় সকলের সঙ্গে তাঁর মেলামেশায় বাধা ছিল। কিন্তু তিনি টান অনুভব করতেন সেই সহজ-সরল মাটির মানুষগুলোর প্রতিই।
"কেন জানিনা জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলেই থাকতে ভালোবাসতাম। আর বড় ভাল লাগত সেই সহজ সরল মানুষগুলোকে, গুরুজনরা যাদের বলতো সাধারণ লোক। যাইহোক, অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকের মাঝেই নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলাম শৈশব থেকেই”...(‘শচিন কর্তা’/পান্নালাল রায়)
বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার ফলে বাংলার লোক সুর আর মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে মিশে তাদের সুর তুলে এনেছিলেন আর আশ্চর্য দক্ষতায় শাস্ত্রীয় সুরের সঙ্গে মাটির সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে সঙ্গীতকে দান করেছিলেন অপার ঐশ্বর্য।
শচিন দেবের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হল ১৯৩২ -এ হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে। তাঁর কিছুটা আনুনাসিক কন্ঠস্বরের জন্য প্রথমে তখনকার মুখ্য রেকর্ড কোম্পানী এইচ এম ভি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে প্রথম রেকর্ড প্রকাশের পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
শচীন দেব তাঁর জীবন কথায় লিখে গেছেন “১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত এই ৫/৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সংমিশ্রনে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম - যা অন্য কারো সঙ্গে মিলল না। এইভাবে আমি আমার নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম”.......(সূত্র - ‘শচিনকর্তা’/পান্নালাল রায়)
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে বাংলা ছায়াছবি শচীন দেবের সুরের ঐশ্বর্য প্রায় বর্জনই করেছিল। ১৯৩২ -এ বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর ১৯৩৮ -এর মধ্যে বাণিজ্যিক ভাবে অসফল কয়েকটি মাত্র বাংলা ছায়াছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন। হয়তো তাঁর রুচি এবং আভিজাত্যের কারণে তিনি সেই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের সংগীতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন নি।
এটা নিয়ে তার অভিমানও ছিল। তিনি অন্যের সুরে গান করতেন না। সঙ্গীত পরিচালক অন্য কেউ হলেও তাঁর গাওয়া গানের সুর তিনি নিজেই করতেন। দুটি মোটে বাংলা ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, তারপর কোন প্রযোজক, পরিচালক তাঁকে ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ দেন নি। কোন ডাক না পেয়ে কিছুটা অভিমান নিয়েই বাংলা ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯৪২এ মুম্বই যাওয়ার প্রথম ডাক পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বাংলাতেই থাকার। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র জগত থেকে কোন সাড়া না পেয়ে অভিমানাহত হয়ে ১৯৪৪ -এ মুম্বাই চলে গেলেন পাকাপাকি ভাবে। "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আত্মকথনে (মার্চ ১৯৬৯ -এ শচিনদেব লিখেছিলেন - “বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করার আকাঙ্খা ছিল খুব। কিন্তু কোন সুযোগই পাচ্ছিলাম না। কোথাও কোনো চলচ্চিত্র সংস্থা আমাকে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ না দেওয়াতে মনে খুবই দুঃখ হয়েছিল।"
তাই ১৯৪৪ -এ দ্বিতীয় বার যখন মুম্বাই থেকে ডাক পেলেন, আর ফিরিয়ে দিলেন না। তারপর হিন্দি সিনেমার গান তাঁর সুরের জাদুতে কি অসামান্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে আছে। মুম্বাই সিনেমার গান ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠলো বাংলার মাটির সুরের স্পর্শে। তিনি হিন্দি সিনেমার গানের জগতের 'এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন'। সৃষ্টি হল অমর কালজয়ী কিছু গানের সুর।
এবং তার সাথে মিশে রইল বাংলা ভাটিয়ালি এবং মাটির সুর। যেমন মোহাম্মদ রফির গাওয়া "দিল কা ভাঁওয়ার করে পুকার" অথবা লতা মঙ্গেশকারের গাওয়া "নিন্দ চুরায়ে চ্যায়ন চুরায়ে" বা কিশোরকুমারের "রূপ তেরা মস্তানা". অথবা "ধীরে সে যানা বাগিয়ান মে" এই গানগুলিতে বাংলা লোকগানের প্রভাব স্পষ্ট।
বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। একমাত্র পুত্র রাহুল দেব বর্মন সঙ্গীত জগতের আরেক দিকপাল।
শচীন দেব বর্মন নিজের নিয়মে চলতেন। তিনি যখন হিন্দি সিনেমার গানে সুর দিতে আসেন সেই সময় নিয়ম ছিল যে আগে গান লেখা হবে তারপর সুর দেওয়া হবে কিন্তু তিনি নিয়ম করলেন যে তিনি আগে সুর করবেন তারপর তাতে গানের কথা বসানো হবে। লতা মঙ্গেশকার তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী ছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একবার মতান্তরের কারণে লতাজির মতো গায়িকাকে দিয়েও বহুদিন তাঁর সুরে গান করাননি তিনি।
এখানে বলা যেতে পারে পৃথিবী বিখ্যাত ক্রিকেটার শচীন তেনদুল্কারের নামও তাঁর নাম থেকেই রেখেছিলেন শচীনের পিতা।
ছিলেন খাঁটি বাঙালি...বলা ভাল খাঁটি বাঙাল। আমৃত্যু ইস্টবেঙ্গলের ভক্ত ছিলেন তিনি। বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন চিরদিন। ৩১শে অক্টোবর ১৯৭৫-এ এই পৃথিবী ছেড়ে সুরলোকের অন্য জগতে চলে যান তিনি।
কিন্তু অমর হয়ে থাকলেন তাঁর গানে তাঁর সুরে....
"বাংলা জনম দিলা আমারে
তোমার পরান আমার পরান
এক নাড়িতে বাঁধা রে
মা পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার
সাধ্য কারো নাই
সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা
বাংলা মায়ের কোল"....