‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে..হৃদয়ে দিয়েছো দোলা’ –প্রজন্মের প্রখ্যাত সুরস্রষ্টা শচীন দেব বর্মনের স্বীয় সুর-গায়কীতে এ গান যেন তাঁরই আয়না। প্রকৃত সুরের দোলা দিতে পেরেছিলেন বলে আজও ‘শচীন কত্তা’ হিসেবে রয়ে গিয়েছেন আপামর বাঙালি হৃদয়ে।
ত্রিপুরার বিখ্যাত রাজপরিবারের অংশীদার হয়েও জমিদারি নয়, তিনি বেছে নিয়েছিলেন সঙ্গীতকে। কৃষ্ণ চন্দ্র দে, বিষ্ণুদেব চট্টোপাধ্যায়, ওস্তাদ বাদল খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এতসব জ্ঞানী মানুষের শিক্ষা, সান্নিধ্য, সংস্পর্শে বড় হয়ে ওঠা তাঁর। আজীবন প্রচুর জনপ্রিয় হিন্দি-বাংলা গানের জন্ম দিলেও, জন্মস্থান কুমিল্লার গ্রাম-বাংলাই ছিল তাঁর সঙ্গীত শিকড়। জীবনের প্রায় ১৯ টি বছর কাটিয়েছেন সেখানে। ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার জন্য কুমিল্লা ছাড়েন। ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’ , ‘এই পথে আজ এস প্রিয়া’, ‘ও কালো মেঘ বলতে পারো’, ‘এই কাননের ফুল নিয়ে’, ‘স্বপন না ভাঙ্গে যদি’, ‘আজি রাতে কে আমারে’, ‘রইব না আর উজান’, ‘প্রানের প্রভু রহে প্রানে’, ‘মন দুখে মরিরে সুবল’, ‘কণ্ঠে তোমার দুলে বলে’, ‘এই মহুয়া বনে’, ‘নিশীথে যাইও ফুল বনে’, ‘স্বপন দেখেছে গিরিরানী’, ‘বিদায় দাও গো মোরে’, ‘বন্ধু বাঁশি দাও মোরে’, ‘ওরে সুজন নাইয়া’ –তাঁর এই বিখ্যাত বাংলা লোকগান গুলি থেকেই বোঝা যায় গ্রাম বাংলার রূপ-প্রকৃতি তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল।
বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মন ত্রিপুরার বিখ্যাত রাজপরিবারের রাজত্বের অংশীদার ছিলেন। শোনা যায়, পারিবারিক জটিলতা আর ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে ক্ষোভ, অভিমান ও বিবাদ এড়াতে তিনি ত্রিপুরা ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যান। ৬০ একর জমির ওপর গড়ে তোলেন রাজবাড়ী। সেখানেই নয় ভাই বোনের কনিষ্ঠ শচীন দেবের জন্ম হয়। কুমিল্লার রাজবাড়িতে রাজকীয় মহিমা-মর্যাদা বা উপাধি ছিল না, ঐশ্বর্য ছিল না তেমন, কিন্তু রাজপরিবারের আভিজাত্যের অহংকার অনেকখানিই ছিল।
এই আভিজাত্যের অহংকারেই রাজপরিবারের নিয়ম ছিল সাধারণ মানুষ থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা নিষেধ ছিল। কিন্তু এ সব আদেশের তোয়াক্কা না করে শচীন ছোট বেলা থেকেই সাধারণ গ্রাম-বাংলার মানুষের সাথে চলাফেরা শুরু করেন, মাটির টানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন। স্বয়ং ‘এস ডি’ বর্মন বলেছেন-
“রাজবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী জনসাধারণের থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গুরুজনেরা আমাদের শৈশব থেকেই সচেতন করে দিতেন। তাঁরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, যাতে তাঁদের মতে যারা সাধারণ লোক তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করি। আমি তাঁদের এ আদেশ কোনোদিনও মেনে চলতে পারিনি। কেন জানি না জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলে থাকতে ভালোবাসতাম। আর আপন লাগত সেই সহজ- সরল মাটির মানুষগুলোকে, যাদের গুরুজনেরা বলতেন সাধারণ লোক। যা-ই হোক, অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকদের মাঝেই নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সাথে এক হয়ে গেলাম শৈশব থেকেই। আমার এ আচরণ রাজবাড়ির কেউ পছন্দ করতেন না।”
তাঁর লোকগানের হাতেখড়ি এই সাধারণ মানুষের হাত ধরেই। বাড়িই দুই পরিচারক মাধব ও আনোয়ারের কাছেই তাঁর প্রথম গানের ‘কান’ তৈরী হয়।
ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী ও সেতার বাদক বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছ থেকে প্রথম মার্গসঙ্গীত শিক্ষা লাভ করলেও শুধু এটাতেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। ঝুঁকে যান গ্রাম্য সংগীতের দিকে; লোকগান, ভাটিয়ালি গানের দিকে। বাড়ির পরিচারক মাধবের কাছে শ্রুতিমধুর রামায়ন শুনে, আনোয়ারের সাথে মাছ ধরে আর তাদের কাছে গান শুনে শচীনের সময় কাটত। তাঁর স্মৃতিকথায়, “আনোয়ার ও আমি সুযোগ বুঝে ছিপ নিয়ে বসে যেতাম, আর দুজনে মাছ ধরতাম। তারপর গান গাইতে গাইতে পুকুরের ধারে ধারে ও বাগানে দুজনে বেরিয়ে মনের কথা বলতাম। আনোয়ার রাত্রে তার দোতারা বাজিয়ে যখন ভাটিয়ালি গান করত তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করার দফারফা হয়ে যেত।”
নিজের গান সম্পর্কে শচীন কত্তা বলেন, “লোকসংগীত ও ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের সংমিশ্রণে একটি নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করেছি, যা বিদগ্ধজনের কাছে আদৃত হয়েছে।” কলকাতায় সলিল ঘোষকে গান শোনাতে গিয়ে কর্তা বলেন, “বুঝলে সলিল, গ্রাম্য কথাগুলি রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। এতদিন গ্রাম ছাড়া হয়ে থেকেও এখনো সেই কথাগুলি ঘুরেফিরে মনে আসে।”
ত্রিপুরা সম্বন্ধে প্রবাদ আছে যে, সেখানকার রাজবাড়িতে রাজা, রাণী, কুমার, কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত সবাই গান গায়। গলায় সুর নেই, গান গাইতে পারে না এমন কেউ নাকি সেখানে জন্মায় না। ত্রিপুরার ধান ক্ষেতে চাষী গান গাইতে গাইতে চাষ করে, নদীর জলে মাঝি গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানে না, জেলে গান গেয়ে মাছ ধরে, তাঁতী তাঁত বুনতে বুনতে আর মজুর পরিশ্রম করতে করতে গান গায়। তাই এ কথা বলাই যায় বাবার কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু করা শচীনেরও রক্তে-মননে মিশে ছিল এমন সব মাটির মানুষের গান।