“তুমহারা কাপড়া বহত গন্দা হ্যায়। বহত আরশোলা হ্যায়।
ফুরফুর ফুরফুর করে ঘুরতা হ্যায় ঔর গায়ে মে বসতা হ্যায়...”
দূরপাল্লার ট্রেন সফরে রেলের কামরায় এক বাঙালি প্রৌঢ়ার তর্জন গর্জনের সামনে পড়ে ভয়ে কাঁচুমাচু দশা দায়িত্বে থাকা রেলকর্মীর। আরশোলা থেকে বাথরুম নিয়ে নালিশ চলছেই। হিন্দি আর বাংলার মিশেলে সে এক দুরন্ত কথোপকথন। তার সামনে পড়ে রেলকর্মীটির মতোই যেন অবস্থা প্রৌঢ়ার স্বামীর।
ডায়লগ আর অভাবনীয় অভিনয়ে এতটুকু দাঁড়াবার জায়গা নেই সহ-অভিনেতার। হলেই বা তিনি বাংলা ছবির মহীরূহ, তবু ‘সাবু’ কী কম যান! তিনিও যে আর এক বটবৃক্ষ!
প্রৌঢ়ের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর দজ্জাল প্রৌঢ়া সাবিত্রী। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ঘরের ‘সাবিত্রী’। আজও তিনি একই রকম। তেজি বালিকা। টরটরিয়ে কথা বলেন। বুকে তির বেঁধান অভিনয়ে। বছরের পর বছর ধরে তাঁকে যে এভাবেই চিনে আসছে দর্শক।
মনমোহিনী রূপ অনেক দেখেছে বাঙালি দর্শক, কিন্তু এমন ডাগর চোখের মেয়ে আগে দেখেনি তারা। এত প্রাণবন্ত যে চুপ থাকলেও মনে হয় চোখ দিয়ে সব কথা বলা হয়ে গেল তার। এমন অভিব্যাক্তির কাছে ক্যামেরায় যেন অসহায়। ব্যথাভরা চোখে যখন তাকাত সেই মেয়ে বুক ভাঙত বাঙালির।
অথচ এমন কাঁদুনে মেয়ের অভিনয় মোটেই ভালবাসতেন না সাবিত্রী। কমিক অভিনয় বরাবরের টান। সাবিত্রীর কমিক বললেই এক দমকে মনে চলে আসে মৌচাক ছবির আর দজ্জাল মহিলাকে। বাড়ির সর্বক্ষণের সঙ্গী মেয়েটিকে হাতেনাতে প্রেমিক সমেত ‘অ্যারেস্ট’ করা আর তাঁকে ধরতে ঘরময় দৌড় আজও মন ভাল হওয়ার দাওয়াই। আর এক ছবি ধন্যিমেয়ে। ফুটবলপাগল ব্যবসায়ীর স্ত্রীর ভূমিকায় ধুন্ধুমার লেগেছিল পর্দায়। অনবদ্য অভিনয়ে সেই ছবি কনওদিন পুরনো হওয়ার নয়।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের চোখকে একসময় বলা হত ‘টালার ট্যাঙ্ক’, কল খুললেই জল। কিন্তু কমেদি ছবিতে বারবার গোল দিয়েছেন তিনি। কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিকে করেছিলেন ‘পাশের বাড়ি’ ছবিটি। সঙ্গে ভানু বন্দোপাধ্যায় আর অনুপকুমার। তুমুল হিট হয় সেই ছবি।
পরবর্তী সময়ে ‘ভ্রান্তি বিলাস’। উত্তমকুমারের বিপরীতে সেই ছবিও দর্শক টানে। ছোট রোল কিন্তু মজার- শুধু এই কারণেই প্রাক্তন ছবিতে অভিনয়ের জন্য রাজী হয়েছিলেন। তবে প্রধান কারণ কিন্তু ‘সৌমিত্রবাবু’। তাঁর কথায় ‘সৌমিত্রবাবু ছিলেন বলেই আমি ছিলাম’। শুধুমাত্র অন্যরকম অভিনয়ের খিদের টানে। ‘হিরোইন’-এর রোল বা মুখ্য চরিত্র ছাড়া ছবি করবেন না এমন ভাবনা তাঁর কোনও দিনই ছিল না। দেখতেন শুধু অভিনয় করার জায়গা আছে কিনা। ‘প্রাক্তন’ ছবিতে তাই নিজের চেনা মেজাজেই দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
শুটিঙের সময় তাঁর অভিনয়ে দেখে হেসে ফেলেছিলেন পরিচালক স্বয়ং। ফ্লোর জুড়ে হাসি। তাঁর নিজের ভাষায় ‘কমেডি সেন্স আমার ভীষণ ভাল’। কমিক রোল করতে ভীষণ ভালবাসেন। সেই অভিনয় তাঁর ভিতর থেকে আসে।
চোখের ভাষায় যতই কথা বলুক বেদনা, তাঁর মনের ভাষা কিন্তু হাঁফ ফেলে হাসিতেই। সব চরিত্রে আশ্চর্য আবেদনময়ী। তাঁর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় উদ্বাস্তু জীবনের অসহায় জীবনের দিনরাতগুলো। সেই অসহায়তাই যে তাঁর আজীবনের জোর। যুদ্ধ জেতার মহৌষধী।