অরুণ ঘোষের স্মৃতিচারণ 'ওই তো মিলখা... ওড়ার জন্য তৈরি' (২০-৬) পড়ে কিছু প্রশ্ন মনে জাগল। আর এক জন মিলখা এ দেশ পেল না কেন? একই ভাবে মনে হয়, ভারতীয় ফুটবল আর এক জন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় বা চুনী গোস্বামী পেল না কেন? কোথাও যেন এই দু'টির মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কেন ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক্সে ৪০০ মিটার দৌড়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের চুলচেরা হিসাবের গরমিলে পদক হারানোর পর মিলখা সিংহকে হাপিত্যেশ করে থাকতে হয় এই আশায় যে, যদি আর কোনও ভারতীয় দৌড়বীর অলিম্পিক্সে পদক জিতে তাঁর ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে পারে?
সোনা, রূপো, ব্রোঞ্জ কোনও পদকই পাননি। কিন্তু ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক্সে চতুর্থ হয়েই মিলখা সিংহ কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ মিলখার সেই চতুর্থ হওয়া ভারতীয় খেলাধুলোয় অন্যতম মাইল ফলক হিসেবে ছয় দশক পরেও রয়ে গিয়েছে। সেই পদক না পাওয়াই ভারতের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উৎসাহ দিয়ে আসছে খেলাধুলোয়।
কিংবদন্তি মিলখা যত না চর্চিত, ছোট মিলখার চর্চা তার থেকে কম কিছু নয়। ১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর এখনকার পাকিস্তানের মুজফফরগড় জেলার গোবিন্দপুরায় জন্ম তাঁর। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারতে চলে আসেন। বাবা, মা, ভাই এবং দুই বোনকে দাঙ্গায় চোখের সামনে খুন হতে দেখেন। মিলখার পনেরো ভাই-বোনের মধ্যে আটজনই দাঙ্গায় প্রাণ হারান।
পাকিস্তানের গোবিন্দপুরায় চোখের সামনে বাবা-মা'কে খুন হতে দেখে কিশোর মিলখা প্রাণ বাঁচাতে দৌড় শুরু করেছিল। তাঁর জীবদ্দশায় অ্যাথলেটিক্সে ভারত অন্তত একটি অলিম্পিক পদক জিতুক, দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৬০-এর ৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ইভেন্টের দৌড়ে ০.১ সেকেন্ডের (অটো টাইমারে ০.১৩ সেকেন্ড) ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্সের পিছনে ফোটো-ফিনিশে দৌড় শেষ করেন। রোমে ম্যালকমের থেকে এগিয়ে থেকেও শেষ ৫০ মিটারে কোথাও একটু ভুল করেছিলেন, বার বার বলেছেন তিনি।
১৯৪৯ সালে ভারতীয় সেনায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন মিলখা। কিন্তু পারেননি। ১৯৫০ সালে ফের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। একটা রাবার কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে সুযোগ পান ভারতীয় সেনায়। মাইনে ছিল ৩৯ টাকা ৮ আনা। শ্রীনগরে তাঁর চাকরি হয়। তখন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন খেলাধুলোয় মিলখাকে দৌড়তে দেখে সেনার আধিকারিকরা তাঁকে আলাদা করে নজর করতে শুরু করেন। স্প্রিন্ট হোক, বা দূরপাল্লার দৌড়, ধারাকাছে কাউকে আসতে দিতেন না। শেষ পর্যন্ত ৪০০ মিটারকেই পাখির চোখ করেন। সেনা কর্তাদের তত্ত্বাবধানেই শুর হয় মিলখার উড়ন্ত শিখ হয়ে ওঠার যাত্রা।
১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে সুযোগ পান। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যান। দুই বছর পর কার্ডিফে কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সোনা জেতেন। ৪৬.৬ সেকেন্ড সময় করে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্সকে হারান মিলখা। ৫২ বছর পর্যন্ত এই নজির মিলখার একারই ছিল। ২০১০ সালে দিল্লি কমনওয়েথল গেমসে ডিসকাস থ্রো-তে কৃষ্ণা পুনিয়া সোনা জিতে মিলখার মাইলফলক স্পর্শ করেন।
১৯৫৬ এশিয়ান গেমসে ২০০ ও ৪০০ মিটারে সোনা জেতেন। ১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী পান। ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটারে আবার সোনা জেতেন।
১৯৬০ সালে মিলখার নামের সঙ্গে 'উড়ন্ত শিখ' যোগ হয়। লাহোরে 'ডুয়াল চ্যাম্পিয়নশিপ'-এর সময় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান মিলখার দৌড় দেখে তাঁকে এই নাম দেন। কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে 'উড়ন্ত শিখ'-এর মনে ছোটবেলার ক্ষতগুলো বারবার ফিরে আসে। ফলে তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যায় এই প্রতিযোগিতা। শেষ পর্যন্ত জওহরলাল নেহরুর কথায় অতীত ভুলে ট্র্যাকে নামেন।
সেই বছরই মিলখার জীবনে সবথেকে বড় সাফস্য আসে। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক্সে ৪০০ মিটারের চতুর্থ হন। তার আগে যে ফর্মে তিনি ছিলেন, তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন পদক মিলখার গলাতেই ঝুলবে। কিন্তু ২৫০ মিটারে পৌঁছে ভুল করে ফেলেন মিলখা। জিতছেন ধরে নিয়ে গতি কমিয়ে দেন। তাতেই অল্পের জন্য পদক থেকে বঞ্চিত হন।
তরুণ প্রজন্মকে কখনও বঞ্চিত করেননি তিনি। এর জন্য ২০০১ সালে অর্জুন পুরস্কার প্রত্যাখান করেন। ভারত সরকারকে জানান, এই পুরস্কার তরুণদের জন্য, তাঁর মতো বুড়োরা এর যোগ্য নয়।
মণিপুরের মৈরাং থেকে নেতাজি জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মশাল-দৌড় অনুষ্ঠানে ১৯৯৭-এর ২২ জানুয়ারি কলকাতা বিমানবন্দরে সহযাত্রী হিসেবে একান্ত আলাপচারিতায় মিলখা বলেন, বাংলার গ্রামগঞ্জে আনাচকানাচে সংগঠিত ট্রেনিং সেন্টার ও কোচিংয়ের যা খবর পান, তা অন্য কোনও রাজ্যে তিনি দেখেননি। কঠিন সঙ্কল্প, শৃঙ্খলা, অনুশীলন ছিল তাঁর সাফল্যের মন্ত্র।
মিলখা সিংহ এক সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনে উল্লেখ করেছিলেন, ক্রিকেটের প্রতি তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। সত্যিই হয়তো তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল না। কিন্তু পরোক্ষে তো তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, সুষ্ঠ জাতীয় ক্রীড়ানীতি তৈরি না হওয়ার কারণে ক্রিকেটের প্রতি দেশের সকলের অধিক নজর। এবং এই কারণেই ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের চরম ঘাটতি। একই অবস্থা এ দেশের ফুটবলেরও। যে দেশ ১৯৪৮ থেকে প্রায় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দু'টি এশিয়ান গেমস ফুটবলে শুধু জয়ই নয়, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০— পর পর চারটি অলিম্পিক্স ফুটবলে খেলেছিল ও ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক্স ফুটবলে চতুর্থও হতে পেরেছিল, সেই দেশ কোন জাদুমন্ত্রে একেবারে তলিয়ে গেল? এ দেশের ফুটবলের এই শোচনীয় চেহারার জন্য কি দায়ী নয় ক্রিকেটের চোখ ঝলসানো জৌলুস, ও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা? একটা দেশ যদি একটা খেলা নিয়েই সব সময় মেতে থাকে, তা হলে অপর খেলাগুলি কল্কে পাবে কী ভাবে? কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রকের এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই না হতে পারল এ দেশের অ্যাথলেটিক্সে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-এর কোনও উন্নতি, না হল ফুটবলের উন্নতি।
আবার মিলখার মৃত্যুর পর ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী টুইটারে লিখেছেন, 'খবরটা পেয়ে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ। আপনি ভারতের তরুণদের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আপনাকে খুব কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।'
মিলখার সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পাকিস্তানের আব্দুল খালিক। তাঁর ছেলে মহম্মদ এজাজ জানিয়ে দিলেন, মিলখার স্মৃতি চারণ করে সংবাদপত্রে কলামে লিখেছেন "মিলখার মতো আমার বাবাও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তিনিও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর দৌড়নো শুরু করেন। এমনকি, মিলখার মতো আমার বাবাকেও চতুর্থ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৫৬-র মেলবোর্ন গেমসে ১০০ এবং ২০০ মিটারের সেমিফাইনালে তিনি চতুর্থ হয়েছিলেন।"
এজাজ জানিয়েছেন, ২০০৯-এ 'ভাগ মিলখা ভাগ' সিনেমায় তাঁর বাবাকে দেখানোর জন্য স্বত্ত্ব গ্রহণের সময় প্রথম মিলখার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। কী কথা হয়েছিল তখন? এজাজ লিখেছেন, "মিলখাকে আমি বলেছিলাম, উনি দারুণ দৌড়বিদ। মিলখা আমাকে উত্তরে যা বলেছিলেন তা এখনও কানে লেগে রয়েছে। উনি বলেছিলেন, 'তোমার বাবা অনেক বড় ক্রীড়াবিদ ছিলেন। আমি ফ্লাইং শিখ নামটা পেয়েছি ওঁকে হারিয়েই। আমার খ্যাতির পিছনে ওর অনেক অবদান রয়েছে'।" এজাজের সংযোজন, "সোনার মতো হৃদয় থাকলে তবেই কোনও মানুষ এ রকম কথা বলতে পারেন।"
১৯৬৪-র টোকিয়ো অলিম্পিক্সের পরেই কলকাতায় রবীন্দ্র সরোবরে সার্ভিসেসের হয়ে জাতীয় গেমসে খেলতে এসেছিলেন মিলখা সিংহ। তার আগে ১৯৫৪-র এশিয়ান গেমসে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটারে সোনা জেতার পাশাপাশি ১৯৬২-র এশিয়ান গেমসেও ২০০ মিটারে সোনা জিতে গোটা দেশের কাছে তারকা হয়ে গিয়েছেন মিলখা সিংহ। তাই তাঁর দৌড় দেখতে প্রচুর মানুষ হাজির হয়েছিলেন। সেদিন সোনা পাওয়া হয়নি মিলখা সিংহের। হারতে হয় তাঁর সতীর্থ মাখন সিংহের কাছে। তবে লাখো মানুষের মনে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন মিলখা।
নিবন্ধকারঃ রিদ্ধি রিত