নিজেকে কখনোই ধর্মের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ধর্ম থেকে বিচ্যুতও হয়ে যাননি কখনও।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার সামির আসাফ তার ‘The Poet of the Poets’ নিবন্ধে লিখেছেন-‘গভীরতার মানদণ্ডে তাঁর তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ ।’
তিনি রুমি। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি। তেরো শতকে যাঁর কলম হতে বেরিয়ে এসেছিল সুফি প্রেমের অঝোর ঝর্না।
নাম মুহাম্মদ, উপাধি জালালউদ্দিন।অধুনা আফগানিস্তানের খোরাসানের অন্তর্গত বলখ শহরে জন্ম।ফার্সি সংস্কৃতি সূফী চর্চার মধ্যবিন্দু তখন বলখ।রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে পড়েছে।
আধ্যাত্মিক মনন বিকাশে বাবার পাশাপাশি ফার্সি কবি আত্তার এবং সানাই দ্বয়ের প্রভাব লক্ষ্যনীয়।
ফার্সি, তাজাকিস্তানী, তুর্কি, গ্রীক, পাস্তুন, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলামানরা গত সাত দশক ধরে তাঁর আধ্যাত্নিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করে আসছে।
সুন্নি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফী- এক দেহে এত সত্তা। এই বিংশ শতকেও তিনি সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি এবং বেস্ট সেলিং পোয়েট।
তাঁর লেখা মসনবী ফার্সি ভাষায় লেখা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। ইরান সাম্রাজ্য এবং বিশ্বের ফার্সি ভাষাভাষীরা এখনও তাঁর লেখাগুলো মূল ভাষায় পড়ে থাকে।
প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, কোরানের আয়াত এবং ব্যাখ্যা, জঠিল এবং বিশাল আধ্যাত্নবাদ থেকে রস নিয়ে রুমি লিখছিলেন মসনবী।যার প্রতিটি পংক্তিতে সন্ধান ছিল ঈশ্বর কে খুঁজে পাওয়ার সহজ রাস্তার।
১২১৫ থেকে ১২২০ সাল। এর মধ্যে পরিবারের সঙ্গে ছোট্ট রুমি রওনা হলেন পশ্চিমে।পশ্চিম এশিয়া তখন অশান্ত। জনপ্রিয় রহস্য কবি আত্তার এর সঙ্গে দেখা সেই পথেই।দেখা মাত্রই চিনেছিলেন আগামীর শান্তি দূত কে।
তিনি দেখতে পেলেন রুমি তাঁর পিতার পিছনে হেঁটে যাচ্ছেন। বললেন, “একটি হ্রদের পিছনে একটি সমুদ্র যাচ্ছে ”। একটি বইও দিলেন বালক রুমিকে “আসরারনামা”। পৃথিবীতে থেকেই কীভাবে আত্মার সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়, তার মুদ্রণ।
এই সাক্ষাৎই বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন।
১৫ নভেম্ভর, ১২৪৪ সাল।জ্ঞান বৃক্ষের অন্তিম ফলটি পেলেন রুমি। দরবেশ শামস তাবরিজি এর সঙ্গে সাক্ষাৎ মুহূর্ত।একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষক এবং আইনজ্ঞ থেকে রুমি একজন সাধু হলেন।
রচিত হতে থাকল একের পর এক স্বর্ণ গজল। একদিন আঙুর খেতে ঘুরতে ঘুরতে বন্ধু হুসাম রুমি কে বললেন এমন একটা বই রচনার কথা যেটা আগামীদিনে অগুনতি অপূর্ণ হৃদয়কে পূর্ণতা দেবে।
একটু হেসে রুমি লিখেছিলেন যে পংক্তিগুলো, সেগুলোই ছিল মসনবী –র প্রথম কিছু লাইন। বন্ধুর আরও অনুরোধে আগামী বারো বছর তিনি পরপর ছয়টি খণ্ড রচনায় নিজেকে সঁপে দিলেন।
শরীর ভাঙতে শুরু করে।নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে রচনা করেছিলেন একটি গজল,- কীভাবে জানব কোন ধরণের রাজা আমার মধ্যে আছে আমার সহচর হিসাবে?আমার উজ্জ্বল মুখে দৃষ্টি দিও না আমার বদ্ধ পাগুলোর জন্য।
১৭ ডিসেম্বর, ১২৭৩। কোনিয়া।চলে গেলেন ভালোবাসার সন্ত। তাঁর পিতার কাছে সমাহিত করা হয় তাঁর মরদেহ।একটি চমকপ্রদ ঘর, ইয়াসিল তুর্ব,সবুজ সমাধি যা বর্তমানে মাওলানা মিউজিয়াম- তাঁর কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
সমাধিফলকে লেখা,যখন আমি মৃত, পৃথিবীতে আমার সমাধি না খুঁজে, আমাকে মানুষের হৃদয়ে খুঁজে নাও।
ইসলামের একজন দার্শনিক এবং মরমী। তাঁর উপদেশ সমর্থন করে ভালবাসার মাধ্যমে অসীম পরমতসহিষ্ণুতা, ইতিবাচক যুক্তি, ধার্মিকতা, দানশীলতা এবং সচেতনতা আজ রোপিত হয়ে আছে কোটি কোটি মনে।
তিনি এবং তাঁর শিষ্যদের কাছে সকল ধর্মই অধিক বা কম সত্য। ইসলাম, খৃষ্টান এবং ইহুদীকে একই দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন তিনি। তাঁর শান্তিপূর্ন এবং সহিষ্ণু উপদেশ সকল ধর্মের মানুষের অন্তর স্পর্শ করেছে।করছে। আজও।
রুমি নবী নন।হতেও চাননি বধ হয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে তিনি উপহার দিয়ে গিয়েছেন একটি ধর্মশাস্ত্র। যে শাস্ত্র মানুষকে নিজের সত্তা ধারণ করতে পারার পাঠ পড়ায়।
তিনি নক্ষত্র। দিনে দিনে আরও জ্বলে ওঠেন। পরিস্কার আকাশে নক্ষত্র কে আরও কাছ থেকে দেখা যায়। মনের আকাশের সমস্ত মেঘ সরালেই তাঁর সন্ধান পাওয়া সম্ভব।