বাল্যবিবাহের শিকার হয়েও জীবন থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অতিথি রাজস্থানের রুমা দেবী

রাজস্থানের বারমেরে জন্ম হয় রুমা দেবীর। একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম। নব্বই-এর এর দশক তখন। মেয়ে হয়ে পড়াশোনা করতে চাওয়া সে সময় ছিল অপরাধ। খুব বেশিদিন পড়াশোনার সুযোগ পায়নি রুমা। খুব ছোটবেলাতেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাকে। যখন রুমার বয়স চার বছর মা পৃথিবী থেকে চলে যায়। বাবাও শোকে ভেঙে পড়ে। রুমার দায়িত্ব তার বাবা দিয়ে যায় রুমার মামা-মামীকে। সেই পরিবারেও কোন সম্মান জোটেনি। ছোটবেলা থেকেই রুমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল। তবে রুমার মামা-মামী কিছুতেই পড়াশোনা করাতে রাজি ছিল না। কিন্তু রুমার দিদা নাতনির ব্যাপারে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। সামর্থ্যের অভাবে নাতনির দায়িত্ব হয়তো একা নিতে পারেননি কিন্তু তাকে সবদিক থেকে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। রুমার দিদা রাজস্থানী এমব্রয়ডারির কাজ খুব ভালো জানতেন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলেও দিদার কাছে বসে সেলাইয়ের কাজ শিখত রুমা। 

"পড়াশোনা না করতে পারলেও যে কাজ করবি মন দিয়ে করবি, সেই কাজ যেন তোর জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।"

দিদার বলা এই কথা একেবারে মন্ত্রের মত করে মনে রেখেছিল রুমা। বাড়ির কাজ আর নিজের এমব্রয়ডারির সেলাইয়ের কাজ শেখা চালাচ্ছিল রুমা। অষ্টম শ্রেণীর বেশি পড়াশোনা করা হয়নি। মেয়ে পড়াশোনায় তেমন ভালো নয়, বিশেষ কোনো পারদর্শিতাও নেই, অর্থাৎ কোথাও সে বোঝা। এই মনোভাব থেকেই রুমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় নাবালিকা বয়সেই। 

a690cbf7-c566-4855-a758-9ffa130c5815

নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে রাজস্থানের বারমেরেই পাশের গ্রামে সংসার করতে আসে রুমা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানসম্ভবা হয় রুমা। শরীর তখনও প্রস্তুত ছিল না। সন্তান জন্মের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রুমা তাকে হারায়। প্রথম কয়েক দিন সন্তান-শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল রুমা। পছন্দের কাজ, নিজের জীবন সবকিছু ভুলতে বসেছিল সে। শ্বশুরবাড়ির পরিবার ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে আসা এই বৌমাকে ভালবাসত ‌। বউমা যাতে দুঃখ ভুলতে পারে তাই তার পছন্দের সেলাইয়ের কাজের সরঞ্জাম তুলে দেয় রুমার হাতে। সন্তানশোক থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ খুঁজে পায় রুমা। সেলাই , এমব্রয়ডারির নানা কাজে নিজেকে আরও ব্যস্ত করে নেয় সে। যদিও তখনও পর্যন্ত সেভাবে বাইরের কাজ করত না রুমা। ওই টুকটাক সে কাজ আর নিজের জামা-কাপড় তৈরি করত।

রুমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মূলত কৃষিজীবী, আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বর্ষাকালে উপার্জনের সমস্যা হতো। পরিবারের এই আর্থিক অবস্থা দেখে সংসারের হাল ধরার কথা চিন্তা করে রুমা। ঠিক করে একটা বিশেষ সেলাই শেখানোর এবং সেলাই শিখে জামা কাপড় তৈরির ব্যবসা শুরু করবে সে। শ্বশুরবাড়ির কাছেই যে সমস্ত মেয়েরা থাকতো তাদের মধ্যে দুজনকে রাজিও করায় রুমা। বাকিদেরও রাজি করানোর চেষ্টা অনবরত চালাচ্ছিল রুমা। কারোর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে রুমার সঙ্গে যোগ দিতে পারিনি আবার কেউ ইচ্ছে করেই যোগ দেয় নি। তবে রুমার হাতের এমব্রয়ডারির কাজ এবং তার সহযোগীদের হাতের শিল্পও ধীরে ধীরে সকলের পছন্দ হওয়া শুরু হয়।

২০০৬ সালে, রুমা দেবী ১১ জন মেয়েকে নিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে একটা পুরনো সেলাই মেশিন কিনে প্রথম এই শিল্পের কাজ শুরু করে। মূলত বালিশের কভার ও ব্যাগ তৈরি করত রুমা দেবী ও তার সহযোগীরা। রুমার কাজের কথা এবং তার সততা, নিষ্ঠার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ধীরে ধীরে অনেক মহিলারা যোগদান করে রুমার সঙ্গে। এমনকি অন্যান্য রাজ্য থেকেও রুমার কাছে কাজ শিখতে গিয়েছিল অনেক মেয়েরা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সেখান থেকে বাদ পড়েনি, অন্য রাজ্যের মেয়েদের কর্মসংস্থানের সুযোগও রুমা ধীরে ধীরে তৈরি করে। সম্পূর্ণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও গ্রামীণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বদল নিয়ে আসে রুমা। নিজের পাশাপাশি অন্যের জীবন গড়ে তোলার শপথ নেয় সে।

২০১০ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় রুমা। প্রথমবার দিল্লিতে গিয়ে নিজেদের হাতে তৈরি জিনিসের প্রদর্শনী করে রুমা ও তার সহযোগীরা। ধীরে ধীরে  এমন নানা প্রদর্শনীতে রুমা অংশগ্রহণ করতে থাকে, নিজের গ্রাম ও আশেপাশের অনেকগুলো গ্রাম থেকে নারীরা রুমার সঙ্গে যোগদান করে। দেখতে দেখতে রুমার সংস্থাটি একটি বিরাট আকৃতি নয়। এখন সেই সংস্থায় বিভিন্ন রাজ্যের মেয়েরা কাজ করছে, রুমাকে নিজের গল্প বলার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেকে পাঠানো হয়, সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও রুমা দেবীকে নিজের কথা বলার জন্য ডাক দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে নারী শক্তি পুরস্কার পেয়েছে রুমা দেবী। রুমা দেবীর জীবন এভাবেই সারা বিশ্বের নারীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...