মধ্যযুগীয় এই নারী পুরুষের বেশভূষায় রাজত্ব চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন

দক্ষিণের কাকতীয় রাজ্য গণপতিদেবের সুশাসনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আশেপাশের অনেক অত্যাচারী রাজ্যকেও পরাস্ত করেছিলেন রাজা গণপতিদেব। এই বিজিত রাজ্য থেকে পাওয়া অপরিমিত ধন-দৌলতে সে সময় দক্ষিণের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হয়। এমনকী নানা স্থানে উৎকৃষ্ট স্থাপত্য নিদর্শন রচনা করে রাজা গণপতিদেব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। নিজের জীবনের ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করেন।

এই গণপতিদেবের কন্যা রুদ্রাম্বা দেবী। গণপতিদেবের আরো দুই মেয়ে ছিলেন, নাগমা ও গণপাম্বা। গণপতির তিন মেয়ের মধ্যে রুদ্রাম্বা ছিলেন সবচেয়ে বিদূষী, বুদ্ধিমতী এবং মেধাবী।রাজ্য চালানোর জন্য গণপতিদেব রুদ্রাম্বাকে উপযুক্ত মনে করলেও সময়মতো তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের।

কিন্তু এই মেয়ের ভাগ্য ছিল অন্যরকম। অল্প বয়সেই রুদ্রাম্বার স্বামী মারা যান। নিজের পুত্র সন্তান নেই আর রুদ্রাম্বার স্বামী নেই তাই গণপতিদের রুদ্রাম্বাকেই তার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী এবং রাজ্যের রাজা হিসেবে মনোনীত করেন। যুদ্ধের কৌশল, রণনীতি, জননীতি এবং রাজনীতি সবই তিনি রুদ্রাম্বাকে নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন। নিজের রাজত্বের চার বছর মেয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন।

বাবার পরে রুদ্রাম্বা নিজে রাজসিংহাসনে বসলেও তিনি জানতেন এত বিশাল রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী একজন নারী এই বিষয়টা হয়তো মেনে নিতে পারবে না রাজত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকা বাকি মানুষরা। তাই গণপতির মৃত্যুর পর অপুত্রা রুদ্রাম্বার উত্তরাধিকারী নিয়ে কোন বৈধতার প্রশ্ন যাতে না ওঠে , তাই গণপতির নির্দেশেই রুদ্রাম্বা তার নিজের বছর সাতেকের দৌহিত্র প্রতাপ রুদ্রকে দত্তক নিয়েছিলেন। প্রতাপ রুদ্র ছিলেন তাঁর এক বোনের সন্তান।

রুদ্রাম্বার বয়স তখন চল্লিশ-এর কিছু নিচেই ছিল। প্রথমদিকে রুদ্রাম্বার সিংহাসনে বসা খুব একটা সহজ হয়নি। সিংহাসনে বসতে গিয়ে তিনি আঘাত পান যখন গর্বিত সামন্ত রাজারা এক নারীর প্রভুত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহের পতাকা তুলে ধরেন। আশেপাশের রাজ্যেরও আক্রমণ সহ্য করতে হয় দেবী রুদ্রাম্বাকে। দক্ষিণের অবস্থা তখন শোচনীয় হয়ে ওঠে। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যাদব-রাজ মহাদেবের আক্রমণ প্রতিহত করতে সবচেয়ে বেগ পেতে হয় দেবী রুদ্রাম্বাকে।

যদিও রুদ্রাম্বা সহজে হার মানার পাত্রী ছিলেন না। কুশলী সেনাপতিদের সাহায্যে তিনি সকল বিদ্রোহই প্রশমিত করতে পেরেছিলেন। অনেক আক্রমণও প্রতিহত করেন। রাজ-কোষাগার লুণ্ঠন হলেও রাজমহলের অন্দরের সংহতিতে অসুবিধা হয়নি। বাইরের বাকি রাজাদের কাছে রুদ্রাম্বা  নিজেকে নারী হিসেবে প্রমাণ করলেও তাঁর অন্তরে কেউ বলতে থাকে এভাবে খুব বেশিদিন চলবে না। কারণ সাময়িকভাবে আক্রমণ প্রতিহত হলেও এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে আশেপাশের রাজ্যগুলো আবার এক নারীর অধিকারে থাকা রাজ্যের উপর আক্রমণ চালাবে না। বারবার এমন আক্রমণ হলে ক্ষতি হবে রাজ্যের, রাজ্যের মানুষের। এক নারীর প্রভুত্ব এত সহজে নর মেনে নেবে না একথা রুদ্রাম্বা বুঝতে পারেন।

রাজ্যের কথা ভেবে তিনি পুরুষ সাজেন। কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। পুরুষের বেশে রাজ্য চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এমনকি নিজের নাম বদলে তিনি গ্রহণ করেন পুরুষের নাম, রুদ্রদেব মহারাজ।

রাজ্য, জীবনের মঞ্চে চলতে থাকে চমৎকার অভিনয়। পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ রুদ্রাম্বা সুন্দর, অনবদ্য অভিনয় করতে থাকেন।রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পেতে থাকেন আশেপাশের রাজ্যরা এবং রুদ্রাম্বার রাজ্যের অধিবাসীরা।

রুদ্রাম্বা রুদ্রদেব মহারাজ হয়ে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ উন্নতির দিকে মন দেন। যুদ্ধবিগ্রহ করে রাজ্যের শান্তি নষ্ট করার ইচ্ছে তাঁর কোনদিনই ছিল না। বাবার কাছ থেকে পাওয়া রাজনীতির শিক্ষা দিয়ে তিনি নিজের রাজ্যের প্রভূত উন্নতি করেছিলেন। তবে তার রাজসভার পুরনো কর্মচারীরাও তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। অত্যন্ত দয়াশীল রাজা ছিলেন রুদ্রদেব মহারাজ। নিজের রাজ্যের কাউকে কোনো সমস্যায় পড়তে তিনি দিতেন না। এমন কী সমস্যায় পড়লেও তিনি রাজকোষাগার থেকে অর্থ সাহায্য করতেন। যথাসম্ভব সাহায্য করতেন রাজ্যের তরফ থেকে।

এভাবেই দীর্ঘ ৩০ বছর রাজত্ব করেছিলেন রুদ্রাম্বা। নিজের রাজত্বের সময় তিনি রাজ্যের নারীদের প্রভূত উন্নতির চেষ্টা করেন। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। একজন নারী হয়েও পুরুষের বেশে তাঁকে রাজ্য চালাতে হচ্ছে এ তার কাছে কম লজ্জার ছিল না। কিন্তু নিজের রাজ্যের ভালোর জন্যই এই পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন।

দীর্ঘ ৩০ বছর রাজত্বের পর রুদ্রাম্বা তাঁর দৌহিত্র প্রতাপরুদ্রকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর আরো পাঁচ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন।প্রতাপ রুদ্রকে তিনি নিজে রাজনৈতিক শিক্ষা দেন। তবে রানী রুদ্রাম্বার মত করে কাকতীয় রাজ্যকে রক্ষা করতে পারেনি প্রতাপ রুদ্র। অল্প সময়ে প্রতাপ্র রুদ্রের হাত থেকে রাজ্য চলে যায়। যদিও রুদ্রাম্বা তখন এই পৃথিবীতে ছিলেন না। সাহসী বিদূষী এই নারী নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন শুধুমাত্র রাজ্যের ভালোর জন্য। মধ্যযুগের নারীদের উত্থানের কথা আলোচনা করলে রুদ্রাম্বার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত একথা বলাই যায়।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...