বাংলা ও বাঙালির গর্বের নাম রসগোল্লা। আবেগ আর ভালোবাসার মিশেলে তৈরি হয় ধবধবে সাদা নরম রসের গোল্লা। মুখে পুরে দিলেই এক মুখ চওড়া হাসির উদয় হয়। রসগোল্লার অপরিহার্য উপাদান হল ছানা। প্রথমদিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি ব্রাত্য ছিল বঙ্গসমাজে, ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘কলকাতা কাহিনী’ বইতে লিখেছেন,
ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই এগুলি ছিল কাঁচা দুধের স্বাভাবিক অথবা কৃত্রিম পরিণাম, কিন্তু দুধের বিকৃতি নয়। ছানা কিন্তু দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি দুধের মধ্যে অন্য দ্রব্য যোগ করে দুধকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এইভাবে দুধকে ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই একে বলা হয় ছানা। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনও উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও তা ছিল না। ফলত ছেনা বা ছানা শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং বাংলাভাষায় এই শব্দটির আগমন ছিল অজ্ঞাত।
সঙ্গত কারনেই হিন্দু শাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় ছানা থেকে প্রস্তুত মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল না। পুজোর ভোগে তো ব্রাত্য ছিলই, এমনকি সাধারণ বাঙালি সমাজেও ছানা খুব একটা সন্মান জন স্থান পেত না। অথচ আজ সেই ছানার তৈরি মিষ্টি ছাড়া আমাদের একটি দিনও চলে না। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অমর সিং অমরকোষ নামে একটি অভিধান রচনা করেছিলেন, তাতে ছানার উল্লেখ রয়েছে। নরম দুধে দই দিলে দুধটা কেটে, যা তৈরি হয় তার নাম ছিল দবিকুর্চিকা। দুধকে ছিন্ন করা হয়েছে বলে, কেটে যাওয়া দুধ বাংলায় ছানা নাম পায়।
দেশীয় মতে, জল এবং দুধের সারাংশ হালকা সুতির কাপড়ে ‘ছেনে’ আলাদা করা হয় বলে ছেনা বা ছানা নামের উৎপত্তি। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম পছন্দের খাবারের তালিকায় ছানা যে উপস্থিত ছিল তার প্রমান একাধিকবার পাওয়া গিয়েছে। চৈতন্য চরিতামৃতে (মধ্যলীলা, তৃতীয়) নানা খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে নারকেল শস্য ছানা শর্করা মধুর উল্লেখ রয়েছে। মহাপ্রভুকে কেন্দ্র করেই গৌড়ের ভক্তবৃন্দদের সৌজন্যে সাধারন মানুষ ছানাকে পবিত্র জ্ঞান করতে শুরু করল। ফলে ছানা জনপ্রিয় হয়ে গেল এবং ছানা থেকে মিষ্টি তৈরি হতে শুরু হল। বাঙালি প্রথমে যে ছানা তৈরি করত, তা ছিল দানাদার এবং আঁটাহীন। যার ফলে ওই ছানা দিয়ে উত্তম মিষ্টি প্রস্তুত হত না। পুর্তগিজদের থেকেই বাঙালিরা প্রথম মিহি ও আঠালো ছানা বানাতে শেখে, তাই ছানার অপর নাম কটেজ চিজ।
বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাশ এই ছানার থেকেই বানিয়ে ফেলেন রসগোল্লা। যা বাঙালির অন্যতম সেরা আবিষ্কার। শোনা যায় গোল্লা পাকানো ছানা দুর্ঘটনাবশত দৈবাৎ কোনও ভাবে ফুটন্ত চিনির রসে পড়ে গিয়েই জন্ম হয় রসগোল্লার!
তাই তো কমলকুমার মজুমদার বলতেন,'নবীনচন্দ্র দাশ, রসগোল্লার কলম্বাস'।
রসগোল্লার সাথে বাঙালির স্মৃতি, আবেগ সবই জড়িয়ে আছে। ১৮৬৬ সাল নাগাদ আবিষ্কৃত হয় রসগোল্লা এবং ১৮৬৮ সালে এর জনপ্রিয়তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজস্থানের কাঠ ব্যাবসীয় ভগবান দাস বাগল একবার তার নাতিকে নিয়ে নবীন এর দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। নাতির জলতেষ্টা পাওয়ায়, মিষ্টির দোকান থেকে জল চাওয়া হল এবং সাথে এল সাদা রসালো টুসটুসে রসগোল্লা। এই মিষ্টি খেয়ে দাদু নাতি খুশ! একেবারে আহ্লাদে আটখানা। তাদের হাত ধরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রসগোল্লা। তবে রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কিন্তু কিংবদন্তির শেষ নেই। এক দল দাবী করেন, কবিয়াল ভোলা ময়রা বাগবাজারের মদনমোহন ঠাকুরের ভোগের জন্যে প্রথম রসগোল্লা বানান। কেউ কেউ বলেন ফুলিয়ার হারাধন ময়রা ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে প্রথম রসগোল্লা বানান।
অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, বেনেটোলার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের বিখ্যাত দীনু ময়রার বংশধর ব্রজ ময়রা রসগোল্লা বানিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত প্রণব রায়ের বাংলার খাবার বই অনুযায়ী, ১৮৬৬ সালে কলকাতার ব্রজ ময়রাই নাকি প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেছিলেন।
তবে শোনা যায় যে, গোপাল গোল্লা নামে প্রায় একই রকম একটি মিষ্টি বাংলায় কিছুকাল আগে থেকেই ছিল। তবে স্পঞ্জ রসগোল্লা যে নবীনচন্দ্রের অনবদ্য সৃষ্টি এই নিয়ে বিতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন।
রসগোল্লার ক্ষেত্রে দুইটি সাধারণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত কলকাতা ও শহরতলিতে স্পঞ্জ রসগোল্লার রমরমা চলে, কিন্তু মফস্বলে যে রসগোল্লা মেলে তা বেশিক্ষণ চিবতে হয় না, মুখে দিলেই মিশে যায়, টুসটুসে রসগোল্লা। হয়ত ময়দা ও ছানার অনুপাতের তারতম্যে এমনটা হয়। রসগোল্লা বহু নতুন মিষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রসগোল্লা থেকেও একাধিক মিষ্টির জন্ম হয়েছে, যেমন আকারে একটু বড় মহারাজভোগ বা রাজভোগ, অনেক রাজভোগের ভিতরে আবার ক্ষীরের একটি স্তরও দেওয়া হয়, রসগোল্লার সাথে কেশর মিশিয়ে হলদে বর্নের কেশর ভোগ, সাদা গোপাল ভোগ ইত্যাদি।
রসগোল্লার আকার ছোট করে অতিরিক্ত চিনির রস ফেলে দিয়ে, দানাচিনি ছড়িয়ে দানাদার, ছোট রসগোল্লা ক্ষীর ও দুধের সাথে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে রসমালাই তৈরি হয়েছে। এটিও নবীনের সৃষ্টি। বাংলায় এমন কোনও মিষ্টির দোকান পাওয়া যাবে না যেখানে রসগোল্লা পাওয়া যায় না। এহেন রসগোল্লার পীঠস্থান বাংলার সাথে রসগোল্লা নিয়ে গোল বাঁধিয়েছিল উড়িষ্যা। তাদের দাবী যে, তাদের ক্ষীরমোহনই নাকি রসগোল্লা আদি পুরুষ। এটি তারা জগন্নাথ দেবের ভোগে অর্ঘ্য হিসেবে বহু প্রাচীন কাল থেকে দিয়ে আসছে!
কিন্তু ক্ষীরমোহনের সাথে রসগোল্লার বহু পার্থক্য রয়েছে, প্রথমই বর্নগত ফারাক। ক্ষীরমোহন কিন্তু সাদা নয় লালচে। ক্ষীরমোহন ছানা ও ক্ষীর মিশিয়ে যেভাবে তৈরি হয়, রসগোল্লা সেভাবে গড়ে ওঠে না। ক্ষীরমোহন রসে চোবানো হয় কিন্তু রসগোল্লার রসে ফোটানো হয়। চৈতন্য চরিতামৃতে জগন্নাথদেবের প্রসাদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তাতে কোনও জায়গাতেই ক্ষীরমোহনের উল্লেখ নেই। দীর্ঘ সংঘাতের পরে বাংলা জয় করে রসগোল্লার ভৌগলিক স্বত্বের গর্বের অধিকার।
মহাকালকে জয় করে রসগোল্লা, আজ প্রায় দুই শতক জুড়ে বাংলার অহংকার। সিটি অফ জয়ের সুইট অফ জয়। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির মন জয় করেছে রসে ডোবানো ছানার গোল্লা। বাঙালি এই রসগোল্লার জন্যে সোজা ব্যাটে ডায়বেটিসকে বাপী বাড়ি যা করে দিতে পারে।
এই রসগোল্লা আবিষ্কার নিয়ে উড়িষ্যার দাবীটি পুরোটাই ছিল ভিত্তিহীন এবং প্রমাদ মাত্র! এই বাগবাজারের নবীন ময়রাই রসগোল্লার আবিষ্কারক। তাঁরাই বিশ্ব মানচিত্রে রসগোল্লাকে স্থান দিয়েছে, রসগোল্লাকে পোর্টেবিলিটি দিয়েছে! এখন ১৪ই দিনটি নভেম্বর বাংলায় রসগোল্লা দিবস পালিত হয়।বাংলা ও বাঙালির সাথে সমার্থক হয়ে গিয়েছে রসগোল্লা।
১৪ই নভেম্বর যে দিনটি সারা বিশ্বে ‘ওযার্ল্ড ডায়াবেটিস দিবস’ হিসাবে জনপ্রিয়, সেটিই বাংলায় ‘রসগোল্লা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে। রসগোল্লা এবং ডায়বেটিস পরস্পরের পরিপন্থী হলেও বাঙালি মিলিয়ে এদের এক করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের ১৪ই নভেম্বর দিনটিতেই রসগোল্লার ভৌগলিক স্বত্ব পায় বাংলা।
আজ সর্বত্র রসগোল্লার জয়জয়কার। বর্তমানে বাঙালি নানান স্বাদের ও রঙের, আকারের অসংখ্য রসগোল্লা বানিয়ে ফেলেছে। এমনকি কাঁচালঙ্কার রসগোল্লারও দেখা মেলে। কিন্তু সনাতনী সাদা রসগোল্লা আর শীতে নলেন গুড়ের লাল রসগোল্লা না খেলে বৃথা বাঙালি জন্ম। বাংলার শীত এ জিনিস ছাড়া অসম্পূর্ণ।
এ স্বাদ আপনাকে অমৃত-অমরত্বকে ত্যাগ করতেও বাধ্য করবে, মুখে দিলেই মনে হবে স্বর্গীয় অনুভূতি। তাই তো আজও বাঙালির পরীক্ষার ফল প্রকাশ থেকে ডার্বিজয়, বিশ্বকাপ থেকে নির্বাচন জয়, বিজয়া থেকে বিয়ে, রসগোল্লা না থাকলে ঠিক চলে না।