গোলাপ সারা বছরই ফুল দেয়; তবে শীতে একটু বেশি দেয়। শীতে আরও আরও বেশি করে ফুল পাওয়ার জন্য শীত পড়ার আগেকার কিছু পরিচর্যা রয়েছে; তার মধ্যে ‘হার্ড প্রুনিং’ বা ‘প্রবল ছাঁটাই’ একটি। শরতের শেষে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে এই ছাঁটাই সেরে ফেলতে হয়। বছরে এই একবার। এতে কী হয়, সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে প্রচুর নতুন শাখার জন্ম হয় এবং প্রতিটি শাখাতেই পুষ্ট কুঁড়ি আসে, অঢেল ফুল হয়। তাছাড়া এই প্রুনিং-এর ফলে গাছের আকারও ঠিক থাকে।
এখন জানুয়ারি মাস। শীতের ভরা মরসুম। শীতের আগে যদি হার্ড প্রুনিং না-করে থাকেন, তাহলে এখন আর করা যাবে না। তাছাড়া হার্ড প্রুনিং তখনই করা হয়, যখন গাছ বেঢপ আকারের হয়ে যায়। এবার আপনার গাছের আকার বেঢপ না-হয়ে থাকলে শীতের আগেও তা করার দরকার নেই। তবে বছরভর সবসময় আমরা শুধু স্লাইট প্রুনিং করবো। এই শীতেও। কেননা, গোলাপের নিয়মই হল, এই গাছে কেবল কচি শাখার মাথায় মাথায় কুঁড়ি আসে। এমনিতেই গাছে নতুন শাখার জন্ম হয়, কিন্তু নিয়মিত স্লাইট প্রুনিং করলে অনেক বেশি বেশি নতুন শাখার জন্ম হয়। ফলে, একটা গাছ থেকে এভাবে প্রতিটি মরসুমে অনেক বেশি করে ফুল পাওয়া যায়। এবার কথা হচ্ছে, এই স্লাইট প্রুনিং আমরা করবো কীভাবে?
গোলাপ গাছের যে সমস্ত ডাল ভোঁতা হয়; মানে, যে সমস্ত ডালে কুঁড়ি আসে না বা যে সমস্ত ডাল কিছুটা বেড়ে আর বাড়ে না, সেখানেই থেমে যায়; এই ডালগুলো কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া যে ডালে ফুল ফোটার পর পাঁপড়ি ঝরে গিয়ে শুধুমাত্র বৃতিটুকু অবশিষ্ট থাকে, সেই ডালগুলোও কেটে ফেলতে হবে। কারণ, ফালতু ডাল রাখা মানে গাছের পুষ্টির ভাগ দিয়ে তাকে অযথা বাঁচিয়ে রাখা এবং ফুলঝরা বৃতি রাখা মানেও সেই একইভাবে পুষ্টির অপচয়। এই অপচয় রোধ করে গাছের কুঁড়িযুক্ত শাখাবৃদ্ধিই হল এই ধরণের প্রুনিং-এর প্রধান উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা রেখে কতটা কাটতে হবে ডাল? ডাল কাটার সময় দেখবেন, যেখানে কাটবেন তার নীচে যেন খানপাঁচেক পাতা অবশ্যই থাকে। এই পাতার কোল থেকেই নতুন শাখারা জন্ম নেবে। প্রুনিং-এর পর অবশ্যই মনে করে ডালের কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট বা হলুদগুঁড়োর পেস্ট বা নেলপলিশ লাগিয়ে দিতে হবে। এতে কাটা অংশে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবে না। আসলে, গোলাপ গাছের কাটা অংশে ফাঙ্গাসের আক্রমণ ঘটার আশঙ্কা অন্যান্য গাছের তুলনায় একটু বেশি। ফাঙ্গাসের আক্রমণ হলেই ডাল হলুদ হয়ে শুকোতে শুরু করে। ফলে, এ-বিষয়ে সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।
এবার আসি গোলাপের শীতকালীন খাবারের কথায়। এই সময় গাছ যেহেতু বেশি ফুল দেয়, সেহেতু খাবারের চাহিদাও এই সময় তার বেশি থাকে। ফলে, সে-কথা মাথায় রেখেই তার খাবারের চার্ট এ-সময় ঠিক রাখতে হয়। পাশাপাশি শীতে যেমন আমরা নিজেদের শরীরের বিশেষ যত্ন নিই, গোলাপেরও এ-সময়ে বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। খাবারের ব্যাপারটা এবং বিশেষ পরিচর্যার বিষয়টি কতগুলো পয়েন্টের আকারে লিখছি, আপনাদের পক্ষে যেভাবে সম্ভব, সেভাবে মেন্টেইন করবেনঃ
ক. গোলাপ একটু বেশিই রোদ পছন্দ করে। গোলাপ থেকে ভালো পরিমাণে ফুল পেতে হলে ছয় থেকে আট ঘণ্টা বেশ ভালো রোদের প্রয়োজন। শীতের যেহেতু খুব নরম, তাই এ-সময় পর্যাপ্ত রোদ আসে এমন জায়গায় টব রাখার ব্যবস্থা করুন।
খ. গোলাপের গাছের গোড়া থেকে ইঞ্চি-তিনেক মাটি ছেড়ে চারপাশ থেকে পুরনো মাটি দুই ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত তুলে নিন। তারপর টবে যে মাটি রইল সেটা বেশ ভালো করে খুঁচিয়ে দিন। এবার যতটা মাটি তুলে নেওয়া হয়েছে, তার সমপরিমাণ খাবারযুক্ত নতুন মাটি তৈরি করতে হবে। এতে থাকবে এক ভাগ নতুন দোআঁশ মাটি, দেড় ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা পাতাপচা সার বা এক বছরের পুরনো গোবর সার, আর বাকি দেড় ভাগে এক চামচ ডাস্ট হাড়গুঁড়ো, এক চামচ খড়িমাটি, আধ চা-চামচ লাল পটাশ, আধ চা-চামচ ফসফেট গুঁড়ো। এগুলো একসঙ্গে ভালো ও ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিন। তারপর টবের মাটি তুলে নেওয়া অংশটা এগুলো দিয়েই পূরণ করে জল ঢেলে দিন। মাটি তুলে নেওয়ায় গাছের শেকড়ে আঘাত লেগে থাকতে পারে, তাই এই অবস্থায় দু’দিন সেমিশেডে রেখে টব আগের জায়গায় দিন।
গ. প্রতি সাতদিন অন্তর সরষের খোলপচানো জল গাছে দিন। পঞ্চাশ গ্রাম খোল এক লিটার জলে কমপক্ষে তিনদিন পচিয়ে, সেই জলের সঙ্গে আরও ছ’লিটার সাধারণ জল মিশিয়ে সেই জল গাছের গোড়ায় দিন।
ঘ. গোলাপ একটু অম্লযুক্ত মাটি বা টক টক মাটি পছন্দ করে। তাই গোলাপের টবে কখনই ডিএপি সার দেবেন না। এই সার মাটির অম্লত্ব নষ্ট করে ক্ষারীয় করে তোলে। এতে করে গাছের ফুলের সংখ্যা কমে যায়। মাটির অম্লত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতি পনেরো দিন অন্তর ভিনিগার জলে মিশিয়ে টবে দেওয়া যেতে পারে। এটা খুব সহজলভ্য একটা জিনিস, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের রান্নাঘরে ভিনিগার থাকেই থাকে। এক লিটার জলে দু’ছিপি ভিনিগার ঢেলে বেশ ভালো করে মেশালে তা পাঁচটি টবে সমানভাবে দেওয়া যাবে। এছাড়া ফটকিরি জলে গুলিয়ে তাও সমান পরিমাণ জলে মিশিয়ে মাটিতে দেওয়া যাবে। বাড়ির ফেলে দেওয়া লেবু, সরবতি লেবুর রস জলে নিংড়ে সেই জল দু’তিন দিন পচিয়ে তা গাছের গোড়ায় দেওয়া যাবে। মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধির জন্য মাসে একবার এক চামচ করে খড়ি মাটি টবে যোগ করা যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভিনিগার জল দিয়ে থাকি, এতে ফুলের আকার খুব বড় হয়, দেশি গোলাপের ফুলও বেশিদিন স্থায়ী হয় এবং গাছের পাতা বেশ চকচকে থাকে।
ঙ. দশ-পনেরো দিন অন্তর ম্যাগনেসিয়াম সালফেট বা এপসম সল্ট এক লিটার জলে এক থেকে দেড় চা-চামচ নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। এমনভাবে স্প্রে করতে হবে, যাতে টবের মাটিও বেশ ভালোভাবে তাতে ভিজে যায়। নিয়মিত এপসম সল্ট ব্যবহার করলে গাছে ফুল বেশি হয়, ফুলের আকার বড় হয়, ফুল বেশিদিন গাছে থাকে এবং গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ম্যাগনেসিয়াম সালফেট বড় এলোপ্যাথি বা মডার্ন মেডিসিনের দোকানে সহজেই পাওয়া যায়।
চ. শীতে গোলাপ গাছ থেকে বেশি বেশি ফুল পেতে অবশ্যই মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা অনুখাদ্য স্প্রে করতে হবে। গুঁড়ো ও তরল দুই আকারেই এটি পাওয়া যায়। এক লিটার জলে দু’গ্রাম বা কুড়ি পঁচিশ ফোঁটা ভালো করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে গাছের পাতায় এবং মাটিতে। মাসে দু’বার এই স্প্রে করলেই যথেষ্ট। অনুখাদ্য যে-কোন সার ও বীজের দোকানে পাওয়া যায়। এছাড়া নার্সারি বা গাছের দোকান থেকেও পাওয়া যায়।
ছ. জৈব বা রাসায়নিক যে-কোন খাবার দেওয়ার তিনদিন পর সকালে রোদ ওঠার পর এক লিটার জলে পঁচিশ থেকে তিরিশ ফোঁটা মিরাকুলান (বা, যে-কোন পিজিআর বা প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটার) ভালো করে মিশিয়ে স্প্রে করবেন। এটি গাছকে খাদ্যগ্রহণে দারুণ উৎসাহ দেয়, সহায়তা করে, প্রচুর ফুল দিতেও সাহায্য করে।
জ. প্রতি কুড়িদিন অন্তর উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি বা দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ এনপিকে আট ইঞ্চির টব প্রতি এক চা-চামচ, দশ ইঞ্চির টব প্রতি দেড় চা-চামচ এবং বারো ইঞ্চি টবের জন্য দুই চা-চামচ করে প্রয়োগ করতে হবে গাছের গোড়া থেকে ইঞ্চি তিনেক দূরে দূরে। দানাদার রাসায়নিক সার দেওয়ার সময় মাটি যেন সামান্য ভেজা ভেজা থাকে। দানা ছড়িয়ে মাটি খুঁচিয়ে মাটির সঙ্গে সেগুলো গলে মিশে যাবার সময়টুকু দিয়ে এক ঘন্টা পরে ভাসিয়ে জল দিয়ে দিতে হবে।
ঝ. গোলাপ গাছে রক্তসার পনেরো থেকে কুড়িদিন অন্তর হাফ চামচ করে টব প্রতি দিতে পারলে খুবই ভালো। বাজারের রক্তসারের পরিবর্তে যদি আপনি নিয়মিত রক্তসহ মাছ ধোয়া জল বা মাংস ধোয়া জল গাছের গোড়ায় দেন, তাহলেও ফুলের সাইজ যেমন বড় হবে, গাছের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকবে; তেমনি প্রচুর ফুলও হবে।
ঞ. ছয় থেকে আট ঘন্টা রোদ যাঁদের ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে আসে না; তাঁরা গাছটিকে সেখানেই রাখবেন, যেখানে সবচেয়ে বেশিক্ষণ রোদ থাকে। এবার যাঁদের ব্যালকনিতে শুধুমাত্র একটি এঙ্গেল থেকেই রোদ আসে, তাঁরা টবের চারটি দিক মার্ক করে নিয়ে এক-একদিন এক-একটি দিক সেই রোদের দিকে ঘুরিয়ে দেবেন। এতে করে গাছটির সমস্ত দিকেই রোদ পাবে এবং তুলনায় বেশি ফুল দেবে।
যতদিন শীত থাকবে, এভাবেই গাছের পরিচর্যা চালিয়ে যান। আর সাধের সাজানো বাগানে গাছভরা ফুলের সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকুন। ও হ্যাঁ, এই ফুল এবং গাছকে পোকামাকড় থেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি দশদিন অন্তর কীটনাশক স্প্রে করতে কিন্তু ভুলবেন না...