ছাদে বা ব্যালকনিতে বাগান করা ছাড়া যে-সব পুষ্পপ্রেমীদের আর অন্য কোন উপায় নেই; তাঁদের অনেককেই নানান অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। তার মধ্যে যে-টা প্রধান, সেটা হল রোদ না-আসার সমস্যা। এই সমস্যা বেশি দেখা যায় ব্যালকনিবাগানের ক্ষেত্রে। সকাল বা বিকেলে যথেষ্ট রোদ আসে, এমন ব্যালকনির অধিকারী সকলে হন না। ব্যালকনির গা-ঘেঁষে থাকা বড় গাছ, বড় বাড়ি বা ঘনিষ্ঠ ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়াল সারাদিনে এক মুহূর্তের জন্যও সেখানে সরাসরি রোদ আসতে দেয় না। এই সমস্যা অনেকেরই। এবার তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাগান করতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য বাগান করার উপায় কী?
আমরা জানি যে, কম-সে-কম ডিরেক্ট সানলাইট না-হলে গাছে ফুল ফোটে না, গাছ খাবার তৈরি করতে পারে না। গাছের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অন্যতম একটি শর্ত হল ‘ডিরেক্ট সানলাইট’। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়; কিছু কিছু গাছ আছে যারা পুরোপুরি ছায়ায় জন্মায়, ছায়ায় বাঁচে, ছায়াতেই অসাধারণ ফুল দেয়—তাদের জন্য সামান্যতমও ডিরেক্ট সানলাইটের প্রয়োজন নেই। যাঁরা রোদবিহীন ব্যালকনিতে সুন্দর ফুলের বাগান করতে চাইবেন, তাঁরা এই ছায়ার গাছগুলো বেছে নেবেন। সেই গাছগুলোর নাম কী? পরিচর্যা কেমন? বলছিঃ
এন্থুরিয়ামঃ চমৎকার ফুল এন্থুরিয়াম। লাল ও গোলাপি রঙেই বেশি পাওয়া যায়। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায় এই ফুল। এ-যেন ঠিক, ‘বিদ্ধ-হৃদয়’। দারুণ চকচকে অসাধারণ সুন্দর ফুল। এই ফুল ব্যালকনিতে থাকলে ব্যালকনির সৌন্দর্যই বদলে যায়। ফুল বারোমাস ফোটে। অত্যন্ত অল্প যত্নে এই ফুল সহজেই চাষ করা যায়; শুধুমাত্র ডিরেক্ট সানলাইট, বেশি খাবার এবং বেশি জল এই গাছের শত্রু।
প্রথম কেনার সময় এই গাছের দাম একটু বেশি পড়ে। তবে একবার কেনার পর এই গাছ আর কেনার দরকার পড়ে না। অল্পদিনেই মূল গাছের চারপাশে ধানের পাশকাঠির মতো নতুন নতুন চারার জন্ম হয়। সেখান থেকে সাবধানে চারাটি আলাদা করে অন্য একটি পটে লাগিয়ে দিলেই আপনি নতুন একটি গাছ পেয়ে যাবেন।
প্রথমে আপনি এই গাছ চার ইঞ্চি পটে লাগাবেন। এই পটের তলায় যেন বেশ কয়েকটা ছিদ্র থাকে। আগেই বলেছি, এই গাছ বেশি জল বা জমা জল একদম পছন্দ করে না; শিকড় পচে, পাতা পচে মরে যায়। তাই জল নিকাশির ভালো ব্যবস্থা এর টবে থাকতে হবে এবং মাটিও এমন হবে, যা অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে না-পারে। এ-কারণেই বিশেষভাবে এর মাটি তৈরি করতে হবে। দু’ভাগ কোকোপিট, এক ভাগ বেলেমাটি, এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর বা পাতাপচা সার একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। গাছের শেকড়ে যাতে ফাঙ্গাস আক্রমণ না-করে, তার জন্য মাটিতে আধ চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড মিশিয়ে দেবেন। তারপর এই মাটি দিয়ে টবের আশিভাগ ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে একটু গর্ত করে তাতে এক চা-চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ছড়িয়ে চারাটি বসিয়ে জল দিয়ে দেবেন।
এখানে বলে রাখি, গাছটি প্রথমবার নার্সারি থেকে কেনার সময় যদি কোকোপিট দিয়ে তৈরি মাটিতে চার ইঞ্চি পটে রেডি করা থাকে; তাহলে তাকে সেই অবস্থাতেই রেখে দিন, এখুনি রিপট করার দরকার নেই। যদি টবের মাটি সাধারণ থাকে, তাহলে গাছটি সাবধানে মাটি-শুদ্ধু টব থেকে বের করে মাটি অংশটা মগের জলে বসিয়ে দিন। মাটি ভিজে গলে গেলে, গাছটির শেকড় পরিষ্কার জলে সাবধানে ধুয়ে এক চিমটে ফাঙ্গসাইড, রুট হরমোন ও এপসম সল্ট ভেজানো জলে পাঁচ মিনিট ডুবিয়ে রেখে যেভাবে বলেছি, সেভাবে রিপট করে দিন।
এন্থুরিয়ামে বেশি জল দেওয়া হলে পাতা পচে যায়; কম হলে আবার পাতা শুকিয়ে যায়। তাই জল খুব বুঝে বুঝে দেবেন। টবের মাটির ওপরটা শুকিয়ে গেছে দেখলে মাটিতে আঙুল ঢোকাবেন, তাতে যদি দেখেন প্রথম পাব শুকনো, দ্বিতীয় পাব অল্প ভেজা; তখন গাছে জল দেবেন, নয়তো নয়। গাছে খাবার দেবেন পনেরো থেকে কুড়ি দিন পর পর। এক কাপ জলে এক গ্রাম মতো উনিশঃউনিশঃউনিশ ব্যালান্সড এনপিকে ভালো করে গুলে গাছে স্প্রে করে দেবেন কিংবা অনুখাদ্য স্প্রে করবেন কিংবা এপসম সল্ট ও সুপার ফসফেট একসঙ্গে এক চা-চামচ পরিমাণে নিয়ে টবের ধার ঘেঁষে ছড়িয়ে দেবেন। আর কিচ্ছু করতে হবে না। গাছ নিজের ছন্দে সুন্দর সুন্দর হৃদয়হরা ফুলে আপনাকে ভরিয়ে রাখবে, সাজিয়ে রাখবে আপনার রৌদ্রহীন ব্যালকনিবাগান।
ইস্টার ক্যাকটাসঃ ব্যালকনিবাগানে হ্যাঙ্গিং পটে অসাধারণ সৌন্দর্য বিলোয় ইস্টার ক্যাকটাস। লাল, গোলাপি, সাদা ও মিক্স কালারের অপূর্ব সুন্দর থোকা থোকা ফুল ফোটে এই গাছে। প্রায় সারাবছরই ফুল দেয় এই গাছ। গাছটির নামে ক্যাকটাস হলেও এই গাছের গায়ে কোন কাঁটা থাকে না। তবে এর পাতাবিহীন শাখা-প্রশাখার রূপ ও বিস্তার ঠিক ক্যাকটাসের মতোই। এই গাছের শাখা নেতিয়ে পড়ে, তাই হ্যাঙ্গিং পটের চারপাশে ঝুলে থেকে এর সপুষ্প শাখা ব্যালকনির সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর শাখার এমন সুন্দর বিন্যাস যে, সেটাও আলাদাভাবে সৌন্দর্যসৃষ্টিতে সাহায্য করে।
প্রথমবার এই গাছ কিনতে হলেও পরবর্তীতে আর কিনতে হয় না। এর শাখা ভেঙে মাটিতে পুঁতে দিলেই এক মাসের মধ্যেই তা নতুন গাছে পরিণত হয়। এভাবেই একটি গাছ থেকে অনেক গাছ সহজেই তৈরি করে নেওয়া যায়। প্রথম অবস্থায় এই গাছ ছয় থেকে আট ইঞ্চি পটে করবেন। গাছটি ধীরে ধীরে প্রচুর ডালপালা ছাড়ে। যখন সে প্রচুর ডালপালা ছাড়বে, ঝাড়ে বাড়বে, তখন অর্থাৎ এক-দু’বছরের মধ্যে বড় পটে রিপটিং করবেন।
ইস্টার ক্যাকটাস গোড়ায় জল জমা পছন্দ করে না। এবং এই গাছ একদম হালকা মাটি পছন্দ করে। তাই বেলেমাটির সঙ্গে সমানভাগে ভার্মি বা এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করবেন। মাটিতে এক মুঠো নিমখোল ও এক চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড মিশিয়ে দেবেন। তারপর ভালো জলনিকাশি ব্যবস্থা রেখে অর্থাৎ জল দিলেই মাটি ভিজিয়ে বাড়তি জল টবের ফুটো বেয়ে বেরিয়ে যাবে, টবে এমন ব্যবস্থা বজায় রাখবেন। টবটি তৈরি মাটি দিয়ে আশিভাগ ভর্তি করে মধ্যিখানে এই গাছের চারা বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে জল দিয়ে দেবেন। পরবর্তীতে মাটি শুকোলে তবেই জল দেবেন। খাবার দেওয়া শুরু করবেন চারা বসানোর একমাস পর থেকে। কুড়ি দিন অন্তর উনিশঃউনিশঃউনিশ এনপিকে খাবার হিসেবে আধ চা-চামচ পরিমাণ টব প্রতি জলে গুলে দিয়ে গেলেই হবে। কখনও সখনও এর বদলে অনুখাদ্য দেবেন। ব্যস, আর কিচ্ছু দিতে হবে না। এতেই ইস্টার ক্যাকটাস রোদ ছাড়াই আপনার ব্যালকনিবাগান ফুলে ভরিয়ে রাখবে প্রায় সারাবছর।
পিস লিলিঃ সাদা রঙের চমৎকার ফুলের জন্যই পিস লিলির কদর। পাতার মতো দেখতে এই ফুল তার ঝকঝকে শুভ্রতা দিয়ে সকলের মনকে স্নিগ্ধ করে, শান্তি দেয়। এই গাছের পাতাগুলোর বিন্যাস এবং সৌন্দর্যও বাগানে আলাদা করে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে বাহারি গাছের মতন। ছোট থেকে বড় বেশ কয়েক রকম আকারের ফুলের ভ্যারাইটি রয়েছে এর। এই গাছ ছায়া ভালোবাসে, কিন্তু গোড়ায় জল জমা পছন্দ করে না। তাই বেলেমাটি জল ধরে রাখে না, আবার জৈব সার ভেজা ভেজা ভাব বজায় রাখে। মাটিতে এটাই চায় পিস লিলি। তাই ইস্টার ক্যাকটাসের জন্য যেভাবে মাটি তৈরি করেছেন, সেভাবেই মাটি তৈরি করে পিস লিলির চারা বসিয়ে দিন। প্রথমে ছয় বা আট ইঞ্চির টবে এই চারা বসাবেন; তারপর গাছের বয়স এক বা দু’বছর হলে বড় পটে রিপটিং করবেন। কেননা, তখন গাছ বেশ ঝাড়ে বেড়ে উঠবে, ছোট পটে তখন সে আর আঁটবে না।
পিস লিলিতেও জল বুঝে বুঝে দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে আসছে দেখলে তবেই জল দেবেন। এই গাছে খাবার দেবেন কুড়ি দিন অন্তর। উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি আধ চা-চামচ হাফ লিটার জলে মিশিয়ে ভালো করে পাতায় স্প্রে করে দেবেন। কিংবা হাড় গুঁড়ো (মিহি) ও নিল খোল এক চামচ করে মাটিতে মিশিয়ে দেবেন। অথবা, ছয় থেকে সাত দানা ডিএপি টবের ধার ঘেঁষে এই গাছে দেবেন। এই খাবারগুলো আসলে অলটার করে দিলেই হবে। আর কিচ্ছু করতে হবে না। অল্প যত্নে এভাবেই পিস লিলি বছরভর আপনার ব্যালকনিবাগানে ফুলে-পাতায় অফুরান স্নিগ্ধ-সৌন্দর্য বিলোবে।।...