সংবাদপত্রের সূচনা, সংবাদ মাধ্যমের কন্ঠরোধ, জনমত গঠন, সংবাদপত্রের ভূমিকা

জীর্ণ জাতির বুকে আশা জাগিয়ে, নবজাগরণের সময় মৌন মলিন ভারতবাসীর মুখে ভাষা জুগিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুরন্ত গতি দিয়েছিল সংবাদমাধ্যম। জনমত গঠনে সংবাদমাধ্যম আজও অদ্বিতীয়। নবজাগরণের আলোকে শিক্ষিত সাধারণ মানুষ তখন নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময়েই তাদের সামনে দর্পনের মত এল সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, তুলে ধরলো সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার প্রতিবিম্ব- তুলে ধরল সমাজে মানুষের অবস্থানের প্রতিচ্ছবি; তৈরি হল জনমত আর মত প্রকাশের ক্ষেত্র।

ভারতে সংবাদপত্রের সূচনা হয়েছিল সাহেবের হাতেই‌। কোম্পানির সিভিলিয়ান হিসাবে এদেশে আসা ইংরেজ কর্মচারীদের অসুবিধার কথা লন্ডন হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৭৬৬ সালে উইলিয়াম বোল্টস্ কলকাতা থেকে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য কোম্পানির কাছে আবেদন করেন, কিন্তু তাঁর আবেদনটি খারিজ হয়ে যায়।

এই ঘটনার প্রায় দেড় দশক পরে জেমস্ অগাস্টাস্ হিকি ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি কলকাতার রাধাবাজার থেকে প্রকাশ করেন ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র Hickey's Bengal Gazette or The General advertiser. 

পত্রিকাটির নামের নীচেই স্পষ্ট উল্লিখিত থাকত পত্রিকাটির চরিত্র-

 "A weekly political and commercial paper opens to all parties but influenced by none."

শাসকের সমালোচনা করায় কিছুদিনের মধ্যেই শাসকের রোষের মুখে পড়তে হয় বেঙ্গল গেজেটকে, গ্রেফতার করা হয় সম্পাদক হিকিকে। যদিও হিকির সাংবাদিকতা ও সংবাদ পরিবেশনের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছে, তবুও শাসকের সমালোচনা ও স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য জেমসের অগাস্টাস হিকির কাছে ভারতবাসী ঋণী হয়ে আছে।

ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে হিকির পরেই যাঁর নাম অবশ্যম্ভাবী ভাবে উঠে আসে, তিনি হলেন জেমস সিল্ক বাকিংহাম। ১৮১৮ সালে Calcutta Journal পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর এই পথ চলা শুরু। প্রথমে সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিক প্রকাশিত এই সংবাদপত্র নির্ভীকভাবে সরকারের সমালোচনা করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। ফলে বাকিংহামকেও সহ্য করতে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষু, তবু স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। এই পর্বে বাকিংহামের সুযোগ্য সহযোগী ছিলেন বঙ্গ সন্তান রাজা রামমোহন রায়। তিনি নিজে এই পত্রিকায় কিছু না লিখলেও, তাঁর সম্পর্কে লেখা কলাম খুব জনপ্রিয় হয়েছিল বলে জানা যায়।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ও স্বাধীন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মতে রামমোহন ছিলেন ভারতীয় সংবাদপত্রের জনক। ১৮১৮ সালেই মার্শম্যানের সম্পাদনায় আরও একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, নাম - সমাচার দর্পণ। সমাচার দর্পনে প্রথম দিকে খবর পরিবেশিত হলেও পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। রামমোহন এবং আরও কয়েকজন এইসকল প্রবন্ধের উত্তর দেওয়ার জন্য নতুন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দে রামমোহন তাঁর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ব্রাহ্মণ সেবধি পত্রিকা। তিনি শুধু একাধিক সংবাদপত্র সম্পাদনার কাজই করেননি, একাধিক ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এরমধ্যে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত 'সম্বাদ কৌমুদী'(১৮২১), ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত 'মিরাত-উল-আকবর'(১৮২২) উল্লেখযোগ্য। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের কন্ঠরোধকারী কুখ্যাত আইন 'Adams gag' এর প্রতিবাদস্বরূপ ১৮২৩ সালে মিরাত-উল-আকবরের প্রকাশনা বন্ধ করে দেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যে অস্থায়ী ব্রিটিশ গভর্নরের নাম চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করবে তাঁর নাম চার্লস মেটকাফ। প্রচুর বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৮৩৫ সালে তিনি শ্বাসরোধী আইনের নাগপাশ থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত করেন। মেটকাফের এই সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করেছিলেন তাঁর কাউন্সিলের আইন বিষয়ক সদস্য মেকলে।

গ্রামবাংলায় ব্রিটিশ শাসকবিরোধী প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার, যিনি ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা পত্রিকায় গ্রামের মানুষদের কথা তুলে ধরেছিলেন। ১৮৩১ সালে সাপ্তাহিক ও ১৮৩৯ সাল থেকে দৈনিক প্রকাশিত সংবাদপত্র সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা ব্রিটিশ শাসকের সমালোচনার জন্য স্মরণীয়। তিনি ব্রিটিশ ভক্ত ভারতীয়দেরও ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছিলেন তাঁর পত্রিকায়‌।

সংবাদ প্রভাকরের পথ ধরেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে যারা কলম দিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা। তিনি স্বত্ত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে লর্ড ডালহৌসির রাজ্য দখলের সরাসরি বিরোধীতা করেছেন এই পত্রিকায়। ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহে সাঁওতালদের পক্ষে কথা বলা, ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহের যথার্থ মূল্যায়ন, বা ১৮৫৯ সালের নীল বিদ্রোহে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরা সবক্ষেত্রেই হিন্দু পেট্রিয়ট নির্ভীকভাবে সংবাদ তুলে ধরেছে সমাজের সামনে।

হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল দলের বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকা ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা কার্যকরী হওয়াতে এদেশের কৃষকদের কী অবস্থা হয়েছিল তা তুলে ধরে। কৃষ্ণকুমার মিত্রদের সঞ্জীবনী কেশবচন্দ্র সেনের সুলভ সমাচার, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সোমপ্রকাশ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা দেশের বিভিন্ন জায়গার চিত্র তুলে ধরে জনমত গঠন করেছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থেকে ইলবার্ট বিল কেন্দ্রিক তর্ক-বিতর্ক সবেতেই সোচ্চার ছিল সোমপ্রকাশ।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের বেঙ্গলি,বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গদর্শন, অমৃতবাজার পত্রিকা, প্রভৃতি পত্রিকা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল শাসকের মনে। ফলে, ১৮৭৮ সালের ১৪ মার্চ আবার সংবাদপত্রের কন্ঠরোধকারী Vernacular press Act প্রণয়ন করা হয়। যদিও ১৮৮১ সালে আবার এই নাগপাশ থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার।

শুধু বাংলা নয়, অন্যান্য ভাষার পত্রিকার অবদানও কিছু কম ছিল না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বাল গঙ্গাধর তিলক সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক মাহরাটা ও মারাঠি সাপ্তাহিক কেশরীর কথা।স্বদেশী আন্দোলন, বয়কট আন্দোলন, কংগ্রেসের মতপার্থক্য সবকিছুই উঠে এসেছে সমকালীন বন্দে মাতরম, সঞ্জীবনী, যুগান্তর- এর পাতায়। সুভাষচন্দ্র বসু সম্পাদিত রাজনৈতিক মুখপত্র ফরোয়ার্ড, দৈনিক বাঙ্গালার কথা, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ, অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক লাঙ্গল প্রভৃতি আরও অনেক পত্রপত্রিকা দেশের যুবসমাজকে জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল।

শুধু বোমা গুলি বারুদ বা ধারালো মারণাস্ত্র না, পরাধীন অনেক ভারতবাসী দেশের জন্য লড়াই করার অস্ত্র হিসাবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম, আর তার ধারও যে কম ছিল না তাই বলাই বাহুল্য।

তাই এই স্বাধীনতা দিবসে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করা বীর বিপ্লবীদের পাশাপাশি এই নির্ভীক যোদ্ধাদের প্রতিও রইল আভূমি প্রণাম।

 

প্রদীপ্তা কুন্ডু

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...