টেনিস থেকে বিদায়ের ঘোষণা করেছেন রজার ফেডেরার। লন্ডনে লেভার কাপে জীবনের শেষ এটিপি প্রতিযোগিতায় নামতে চলেছেন তিনি। প্রতিযোগিতার আগে লন্ডনে পৌঁছে গিয়েছেন ফেডেরার। সেখানে অন্য মেজাজে দেখা গেল ২০ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিককে।
২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক জীবনের শেষ এটিপি প্রতিযোগিতায় নামার আগে নিজেই বিদায়ের চিঠিতে লিখেছেন, '২৪ বছর সময়টা এখন ২৪ ঘণ্টা মনে হচ্ছে।' টেনিস ইতিহাসে ফেডেরারই প্রথম পুরুষ যিনি ২০টি গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন। সত্যিই! ২৪টা বছর কেটে গেল। তবু, তবুও রজার ফেডেরারের অবসর ঘোষণা বিহ্বল করে। মনে হয়, সত্যি? সত্যিই তো? লন্ডনে ওই ফচকে 'লেভার কাপ' ছাড়া আর কোনও দরের টুর্নামেন্টে তাঁকে খেলতে দেখা যাবে না?
২৩ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার ফেডেরারে শেষ ম্যাচ। লেভার কাপে ডাবলসে তিনি নামবেন। তারপর টেনিস ব়্যাকেট তুলে রাখলেও তিনি টেনিসের সঙ্গেই থাকবেন। ৪১ বছর বয়সি এই তারকা তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, "আমি প্রদর্শনী ম্যাচগুলোতে অংশগ্রহণ করব এবং আমি জানি আমার এখনও সুযোগ আছে স্টেডিয়াম ভর্তি করার। তবে এটা সবসময় কেপ টাউনের মত ৫২ হাজার হবে না। আমি কখনও ভাবিনি এখনই অবসর নিয়ে কথা বলতে হবে।''
রজার চিঠিতে লিখেছেন, ''এই ২৪ বছরে দেড় হাজারেরও বেশি ম্যাচ খেলেছি। এখন আমার ৪১ বছর বয়স। শেষ তিন বছর ধরে চোট ও অস্ত্রোপচারে জর্জরিত। কঠিন পরিশ্রমের পরও ফিরতে পারছি না। নিজের শারীরিক সক্ষমতা আর কতদূর টানা সম্ভব তা ভালোই বুঝতে পারছি। গত কয়েকদিনে নিজের ভবিষ্যৎ অনেকটা পরিষ্কার। প্রতিযোগিতামূলক টেনিসে আমার সময় শেষ তা ভালোই বুঝতে পারছি। লাভর কাপই হবে আমার শেষ ম্যাচ।'' চিঠিতে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
এক বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক লিখেছেন, ''তিনি যখন এই গ্রহে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা শুরু করেছিলেন তখনও এই পৃথিবীতে আইফোন আসেনি। তখনও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তখনও ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। তখনও ভারতীয় ক্রিকেটদলের প্রবল পরাক্রান্ত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই তখন থেকে এই সে দিন পর্যন্তও টেনিস বিশ্ব শাসন করেছেন তিনি। যিনি নিজেই বিদায়ের চিঠিতে লিখেছেন, '২৪টা বছর। মনে হয় ২৪ ঘণ্টার মতো কেটে গেল!'''
২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে ১১টি জিতেছেন ফেডেরার। পর পর ২৪টি ফাইনালে জিতেছেন তিনি। ফেডেরার এক মাত্র পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়, যিনি তিনটি স্ল্যাম পাঁচ বার করে জিতেছেন (অস্ট্রেলীয় ওপেন ছ'বার, ইউএস ওপেন পাঁচ বার, উইম্বলডন আট বার)। সবচেয়ে বেশি বার উইম্বলডন জিতেছেন (আট বার)। সবচেয়ে বেশি বয়স্ক খেলোয়াড় (৩৬ বছর) হিসেবে র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে থেকেছেন তিনি। গ্র্যান্ড স্ল্যামের নিরিখে অবশ্য পরে তাকে টপকে গিয়েছেন রাফায়েল নাদাল, নোভাক জকোভিচরা।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সুইজারল্যান্ডের বিয়েল শহর থেকে বাসেল শহরের দিকে একটা গাড়ি ছুটছে। গাড়ির ভেতরে এক কিশোর এবং তার বাবা। জুনিয়র টেনিসে একটা ম্যাচ হেরে বাড়ি ফিরছে ছেলেটা। গাড়ি এগোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ছেলেটা শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই। অঝোরে কান্না চলছে একদিকে, আর নিজের ওপর রাগ। র্যাকেট ছুড়ে, ভেঙে ফেলেও তার কষ্ট কমে না কিছুতেই। এ বার তার বাবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। একটা ম্যাচ না হয় হেরেইছে, তাতে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে! তিনি তো বকেননি হেরেছে বলে। শেষটায়, গাড়ি থামিয়ে ছেলেকে জোর করে নীচে নামালেন তিনি। পুরু হয়ে বরফ পড়ে আছে রাস্তার ধারে। ছেলের মাথাটা সেই বরফের মধ্যে চেপে ধরলেন তিনি, 'তুই শান্ত হ'– এই বলে চিৎকার করতে করতে। সেই ছেলেটাই আজকের রজার ফেডেরার।
আট বছর বয়সে টেনিস খেলা শুরু ফেডেরারের। কোচ পিটার কার্টার সেই কিশোরকে দেখে তখনই বলেছিলেন, এই ছেলে এক দিন এই গ্রহের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড় হবে। কোচের সেই কথা রেখেছেন ফেডেরার। মোট ৩১০ সপ্তাহ র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে থেকেছেন তিনি। তার মধ্যে ২৩৭ সপ্তাহ ধরে টানা এক নম্বরে। এই রেকর্ড এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি।
২০০৩ সালে জীবনের প্রথম উইম্বলডন জিতে নিজের অ্যাকাডেমির কর্তাকে ইমেলে লিখেছিলেন রজার ফেডেরার, 'এভরিটাইম আই প্লে আ গুড শট অর এভরিটাইম আই উইন আ গুড ম্যাচ, আই থিঙ্ক অফ পিটার। আই অ্যাম শিওর, হি উইল বি লুকিং ডাউন অন মি অ্যান্ড হি উড বি প্রাউড। হি ডিড নট ওয়ান্ট মি টু বি আ ওয়েস্টেড ট্যালেন্ট। আই হোপ দ্যাট হি উড বি প্রাউড।' যখনই আমি একটা ভাল শট মারি বা ভাল ম্যাচ জিতি, আমার পিটারের কথা মনে পড়ে।
১৯৯৮ সালে পেশাদারি টেনিস শুরু করেছিলেন ফেডেরার। ২৪ বছর পরে পেশাদারি টেনিসকে বিদায় জানাবেন তিনি। নিজেই জানিয়েছেন, ২৪টা বছর ২৪ ঘণ্টার মতো লাগছে। তবে টেনিস ছাড়বেন না ফেডেরার। জানিয়েছেন, টেনিসকে ভালবাসেন। তাই কোনও দিন টেনিসকে ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু, বারবার চোট ও অস্ত্রোপচার। এ ভাবেই গত তিন বছর কাটিয়েছেন রজার ফেডেরার। তারপরেও তাঁর ভক্তরা আশা রেখেছিলেন, আরও একবার উইম্বলডনে খেলবেন। কিন্তু না। সুইস কিংবদন্তির ঘোষণা, এই লেভার কাপই তাঁর শেষ প্রতিযোগিতা মূলক টুর্নামেন্ট। ফেডেরারের কথায়, 'অবসরের এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে মিঠেকড়া। একদিকে, ট্যুর থেকে যা কিছু পেয়েছি, তা মিস করব। অন্য দিকে, জীবনটা উপভোগ করব। আমি নিজেকে বিশ্বের একজন ভাগ্যবান মনে করি। যে প্রতিভা পেয়েছিলাম, তার জোরে এতদিন ধরে যতটা উচ্চ পর্যায়ে খেলতে পেরেছি, তা আমি কখনও ভাবিনি।'
রজার ফেডেরার শুধু দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড় নন। তিনি সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে নয়নাভিরাম। যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন সেন্টার কোর্টের বাতাসে ভেসে বেড়ান। সাঁতার কাটেন। কী পরিমিতিবোধ! কী অসম্ভব গ্রেস! এক ইংরেজ টেনিস ধারাভাষ্যকার লিখেছিলেন, 'হিজ লেগ্যাসি ইজ হিজ গ্রেস।' রজার ফেডেরারের ঐতিহ্য তাঁর মার্জিত আচরণ।
টেনিস বিশ্ব দেড় দশকেরও বেশি সময় সাক্ষী ছিল নাদাল ও ফেডেরারের দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার। আর এখন, লেভার কাপে রাফায়েল নাদালের সঙ্গে জুটি বেঁধে শেষ ম্যাচ খেলতে নামবেন ফেডেরার। নিজের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে শেষ লড়াইয়ের সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। এটাই রজার ফেডারার। কয়েক দিন আগেই ফেডেরার টেনিস থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, লেভার কাপই হতে চলেছে তাঁর শেষ প্রতিযোগিতা। যেখানে খেলার জন্য দিন দু'য়েক আগে লন্ডনে চলেও এসেছেন সুইস কিংবদন্তি। ফেডেরারের ইচ্ছে ছিল, টেনিস জীবন শেষ করবেন বন্ধু রাফার সঙ্গে জুটি বেঁধে ডাবলসে খেলে। সেই ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে তাঁর। সংগঠকরা পরে জানিয়ে দেন, নাদালকেই সঙ্গী হিসেবে পাচ্ছেন ফেডেরার। অর্থাৎ, টিম ইউরোপের হয়ে ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক ফেডেরার জুটি বাঁধবেন ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক নাদালের সঙ্গে।
এই যে একচল্লিশ বছর বয়সে কম্পিটিটিভ টেনিস থেকে সরে গেলেন তিনি, তার্কিক এবার তুল্যমূল্য বিচার করবে তিনি সর্বকালের সেরা কি না। গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের সংখ্যা দিয়ে 'গ্রেটেস্ট' মাপা যায় কি না, নাদাল বা জকোভিচের থেকে তিনি এগিয়ে না পিছিয়ে?— সারা পৃথিবীজুড়ে বিস্তর নিউজপ্রিন্ট খরচ হবে এ সব নিয়ে। আমাদের মতো নিতান্তই সাদামাটা টিভির টেনিস দর্শকদের সে সবে বয়েই গেল। আমাদের, যাদের নিজেদের বলতে লিয়েন্ডার ছাড়া আর তেমন ভাবে কেউ ছিলই না কোনওদিন, যারা সাউথ ক্লাব ছাড়া চোখের সামনে টেনিস কোর্ট দেখিনি কোনওদিন– অন্য গোলার্ধে বসে থাকা সেই আমাদের জন্যেও রজার ফেডেরার এক আশ্চর্য ইমোশন!
৪১ বছর বয়সি ফেডেরার দীর্ঘদিন ধরে হাঁটুর চোটে ভুগছেন। জীবনের শেষ ম্যাচ খেলা নিয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই টেনিস খেলোয়াড় বলেছেন, ''আমি জানি না, ধকল নিতে পারব কি না। তবে অবশ্যই চেষ্টা করব।'' নাদালের সঙ্গে খেলা নিয়ে ফেডেরারের মন্তব্য, ''এই ম্যাচ একটা অন্য রকম আবেগ নিয়ে আসে। রাফা আমার বিরুদ্ধে নামবে না, আমার সঙ্গে খেলবে, এটা ভেবেই খুব ভাল লাগছে।'' যোগ করেন, ''রাফার সঙ্গে খেলার অনুভূতিই আলাদা। আরও এক বার ওর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাও নিঃসন্দেহে দারুণ হবে। আমি চেষ্টা করব ব্যাপারটা উপভোগ করার। কিন্তু কাজটা খুব সোজা হবে না।''
ফেডেরারের সঙ্গী নাদাল বলেছেন, ''আমার টেনিস জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক জন খেলোয়াড় অবসর নিতে চলেছে। শেষের সাক্ষী থাকাটা খুব সহজ হবে না। ফেডেরারের সঙ্গে আরও এক বার খেলার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।''
আট বছর বয়সে টেনিস খেলা শুরু ফেডেরারের। কোচ পিটার কার্টার সেই কিশোরকে দেখে তখনই বলেছিলেন, এই ছেলে এক দিন এই গ্রহের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড় হবে। কোচের সেই কথা রেখেছেন ফেডেরার। মোট ৩১০ সপ্তাহ র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে থেকেছেন তিনি। তার মধ্যে ২৩৭ সপ্তাহ ধরে টানা এক নম্বরে। এই রেকর্ড এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি।
আরএক কিংবদন্তির মুখে এ দিন শোনা গিয়েছে ফেডেরারের প্রশংসা। তিনি নোভাক জোকোভিচ। ফেডেরারের ২৪ বছরের টেনিস কেরিয়ারে অনেক বারই কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন নোভাক। সার্বিয়ান মহাতারকা মনে করেন, ক্রীড়া জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিটের নাম হল রজার ফেডেরার। এবং টেনিসে তিনি অবিস্মরণীয় এক ছাপ রেখে যাবেন। তার কথায়, ''ফেডেরারের পরম্পরা অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকবে টেনিসের জগতে।''
নোভাক বলেছেন, ''টেনিসে ফেডেরারে প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ও যে ভাবে খেলত, ওর স্টাইল, ওর ছন্দ— সব কিছুই এক জন টেনিস কোচ, খেলোয়াড় বা নিছকই এক জন ভক্তের কাছে নিখুঁত লাগবে।''
জোকোভিচ আরও বলেছেন, ''আমি আর অ্যান্ডি (মারে) দু'জনের কেউই জানতাম না, এটা ফেডেরারে শেষ ম্যাচ হতে চলেছে। যে কারণে এই মুহূর্তটা আরও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।'' তিনি এও বলেন, ''খেলার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিটের নাম হল রজার ফেডেরার। শুধু টেনিসেই নয়। সব খেলার ক্ষেত্রেই বলছি।''
লেভার কাপে টিম ইউরোপের অন্যতম সদস্য হলেন জোকোভিচ। টেনিস জীবনে চার বার গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে জোকারের কাছে হার মানতে হয়েছিল ফেডেরারকে। শেষ বার ২০১৯ সালের উইম্বলডন ফাইনাল। যা ছিল ফেডেরারের টেনিস জীবনের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল।
জোকোভিচ এও বলেছেন, ''কোর্টে আমরা খুব ভাল সময় কাটাতে পারব। এটা ভেবেই ভাল লাগছে।'' কী ভাবে কী করতে চান তিনি, সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন জোকোভিচ। বলেছেন, ''আমরা নৈশভোজে টেনিস, খেলাধুলো, জীবন— এ সব নিয়ে কথা বলব। আমরা সাধারণত এগুলো করি না। কারণ সঙ্গে আমাদের নিজস্ব দল থাকে, পরিবার থাকে। কিন্তু এ বার পরিস্থিতিটা অন্য। আমার টেনিস জীবনের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সময় কাটানোর একটা সুযোগ পাচ্ছি।''
খেলছেন, বড় ম্যাচের চাপ সামলাচ্ছেন, শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, রাজাদের সঙ্গে রয়েছেন, রানিদের সঙ্গে রয়েছেন, কোর্টে নড়াচড়া করছেন, গেমের মাঝখানে কোর্টের ধারে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন, জিতছেন, হারছেন— সব সময় তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক পরিমিতিবোধ। পৃথিবীর সমস্ত ভাষায়, সমস্ত দেশে তিনি একই রকমের মার্জিত। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আফ্রিকান— সমস্ত। পরিমার্জন আসলে তাঁর শিরা, ধমনী, মজ্জায় মিশে থাকে ১৪ বছর আগেও মনে হয়েছিল, কী আশ্চর্য মার্জিত উপস্থিতি! এলোমেলো এবং আপাত-অবাধ্য চুলে আঙুল চালিয়ে শাসন করছেন। প্রতি বার একই রকম ভাবে উঠছে তাঁর আঙুলের গুচ্ছ। একই রকম ভাবে কপালের উপর এসে পড়া চুলের গোছা সরিয়ে দিচ্ছেন কানের পাশে। মধ্য-কুড়ির সেই যৌবনে তাঁর চিবুকে তখনও কিছু বেবি ফ্যাটের মিশেল। কিন্তু অবিশ্বাস্য পোক্ত কাঁধ। ট্র্যাকস্যুটের আপারের জিপ খ়ানিকটা খোলা। ভিতরের সাদা টি-শার্টের আবডালে ছিপছিপে বেতের মতো চেহারা। কী একটা সাংবাদিক বৈঠকে এসেছিলেন যেন। খুব সিরিয়াস কিছু নয়। তাঁর বক্তব্য যতটা না মন দিয়ে শুনছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম মানুষটাকে। কথা বলছিলেন। ভরাট, গম্ভীর, নাভিমূল থেকে উঠে-আসা কণ্ঠস্বরে গমগম করছিল বেজিং অলিম্পিক্সের মেন প্রেস সেন্টারের সাংবাদিক সম্মেলনের কক্ষ। কথা বলতে বলতে হাসছিলেন। মনে হচ্ছিল ঝরঝর করে একরাশ মুক্তোই ঝরে পড়ল বুঝি। কিন্তু কখনও নিজের টেনে-দেওয়া লক্ষ্মণরেখার বাইরে যাচ্ছিলেন না। নিজের উপর কী অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ!
নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত