বড়বাজার থেকে শোভারাম বসাক স্ট্রিট নামে একটা রাস্তা বেরিয়েছে, কলকাতার বহু প্রাচীন রাস্তাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। মেডিক্যাল কলেজের ঠিক উল্টো দিকের আরও দুটি গলি শোভারাম বসাক লেন নামে পরিচিত ছিল। ১৯২৭ সালে কলকাতা করপোরেশন সেই গলি দুটির নতুন নামকরণ করে দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট। শোভারাম বসাকের নাম থেকেই শোভাবাজার আর পৃথক শোভাবাজার স্ট্রিট হয়েছে কি না তা নিয়ে কিন্তু দ্বিমত আছে। চিৎপুর রোডের সংযোগস্থল থেকে অল্প দূরে অবস্থিত সেকালের একমাত্র বাজার, যার নাম ছিল “সুবাহ্ বাজার"।
পরবর্তীকালে উচ্চারণের পার্থক্যে এটিই শোভাবাজার হয়ে যায়। কলকাতার বনেদিবাড়ির দুর্গাপুজো আর শোভাবাজার এখন সমার্থক। তিলোত্তমার অন্যতম একটি বিখ্যাত পুজো শোভাবাজারের রাজবাড়ির পুজো। ইংরেজদের পলাশীর যুদ্ধ জয়, উদযাপন করতেই এই পুজোর প্রচলন হয়।
কিন্তু শোভাবাজার নামটা এল কোথা থেকে? অনেক কলকাতা বিশেষজ্ঞই একথা মনে করেন যে ণামেড় নেপথ্যে রয়েছেন শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব। অন্য একটি দল মনে করেন, যে নবকৃষ্ণ নয়, এই নামের আড়ালে রয়েছেন ওই সময়ের বিখ্যাত ধনী শোভারাম বসাক। ১৬৯০ সাল জোব চার্নকের বিশাল নৌকো এসে ভিড়ল। প্রথমে ভেবেছিলেন গঙ্গার ওই পারে উলুবেড়িয়ায় জাঁকিয়ে বসবেন।
কিন্তু সে পরিকল্পনা বাতিল হল। কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর মিলে একজোট হচ্ছে কলকাতা। তখন শোভাবাজার নামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তার পরিবর্তে ছিল ‘পাবনা-বাসনা’ নামের একটি গ্রাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুতানুটির অন্তর্গত এই অঞ্চলে প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করেছিল, হুগলির আদিসপ্তগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী বসাক ও শেঠদের। সুতানুটির হাটে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে তাঁরা তখন মহানগরীর নামকরা ধনী বাবস্যায়ী পরিবার, এই বসাক বংশেরই একজন বিখ্যাত পুরুষ হচ্ছেন শোভারাম বসাক। তৎকালীন কলকাতার এক বিশিষ্ট ধনী। ইংরেজরাও তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করে চলত।
পুরনো কলকাতার ইতিহাস বলছে, 'শেঠ ও বসাক'-এই তন্তুবায় শ্রেণীটি ছিল কলকাতার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে অন্যতম। ১৫৩০ সাল থেকে হুগলী নদী সংলগ্ন সপ্তগ্রাম তখন ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র। শেঠ ও বসাকদের কলকাতায় আসা সম্পর্কে ভারতকোষ-২য় খন্ড জানাচ্ছে, “সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধশালী ব্যাবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে বসাক ও শেঠ উপাধিধারী চারটি তন্তুবায় পরিবার ছিল অন্যতম। তাহারা আদি নিবাস ত্যাগ করিয়া হুগলী দক্ষিণে চারিদিকের জঙ্গলের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত পরিস্কার যায়গায় গোবিন্দপুর নামক এক নতুন গ্রামের পত্তন করিল এবং অপর কয়েকটি তন্তুবায় পরিবারকে আহ্বান করিয়া সেখানে এক বৃহৎ উপনিবেশ গড়িয়া তুলিল। কালক্রমে এই বসাক শেঠদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়িয়া ওঠে কলিকাতার উত্তরে সুতানুটি হাট নামে এক বৃহৎ বানিজ্যকেন্দ্র”।
শোভারাম বসাকের জন্ম আনুমানিক ১৬৯০ সালে। কলকাতায় ইংরেজদের কুঠি নির্মাণের পর গোবিন্দপুর অঞ্চলে চলে আসেন তাঁরা। পরে বড়বাজারে জমি কিনে বাড়ি বানান এবং ব্যবসা করে ধনী হয়ে ওঠেন। শোভারাম সম্পর্কে নানান গল্পকথা, লোককথা ছড়িয়ে আছে কলকাতার ইতিহাসে যেমন শোভারামের বংশধরদের কোন বধুর নামে একটা বাজার ছিল, এবং থেকেই নাকি ‘বউবাজার’ নামের উৎপত্তি।
শ্যামবাজারে সেই সময়ে একটা বাজার ছিল। হলওয়েল সাহেব যার নাম দিয়েছিলেন চার্লস বাজার। শোভারামের অনুরোধে তাঁরই এক আত্মীয় শ্যামচাদ বসাকের নামে ঐ বাজারের নাম হয় শ্যামবাজার আর শ্যামপুকুর স্ট্রিট। আজকের শোভাবাজার রাজবাড়ির পূর্বদিকে ছিল শোভারামের বিরাট শাক-সবজির বাগান। পরবর্তীতে সেটাই পরিণত হয় বাজারে, অঞ্চলটির নাম হয় ‘শোভাবাজার’।
অপর দিকে, নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন ইংরেজদের মুন্সী। তাঁর ‘রাজা’ উপাধিও ইংরেজদেরই প্রদত্ত, সাহেবদের উমেদারির পুরস্কার। পলাশির যুদ্ধে তিনি সিরাজদৌল্লার বিপক্ষে অর্থাৎ, ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন। পুরস্কারস্বরূপ লর্ড ক্লাইভ তাঁকে অনেক কিছুই দিয়েছিলেন। রাজবাড়ীর পুজো শুরুই হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় উদযাপনের জন্যেই।
শোভারাম বসাকের কিন্তু এমন কোনো চাটুকারিতার ইতিহাস নেই।
শোভারাম বসাকের বিখ্যাত সুতোর হাটটি ছিল এই সুতানুটিতেই। অনেকেই মনে করেন, এই সুতোর হাটই কালক্রমে শোভারামের নামে শোভাবাজারে পরিণত হয়েছে। শোভাবাজার নামকরণের দ্বিতীয় মতটিকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়; কারণ এই মত অনুযায়ী, শোভাবাজার নামটি এসেছে ‘সভাবাজার’ থেকে। আর এই নামকরণের ইতিহাসে জড়িয়ে আছেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।
সুকুমার সেন, তাঁর বিখ্যাত ‘বাংলা স্থাননাম’ বইয়ে লিখেছেন, “ঠিক বানান হইবে সভাবাজার, নবকৃষ্ণের ‘রাজসভা’ হইতেই এই নামের উৎপত্তি।” এর থেকে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের বয়ানে। ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে তিনি বলছেন, ১৭৭৫ সালে, নবকৃষ্ণ দেবের মা মারা যাওয়ায় তিনি এক বিরাট জাঁক-জমকপূর্ণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। সেখানে রাজা-মন্ত্রী-জমিদার ধনীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোজসভার আয়োজন ছিল রাজকীয়। এই ঘটনা থেকেই সুতানুটির ‘পাবনা-বাসনা’ গ্রামটি নাম বদলে হয়ে যায় ‘সভাবাজার’। কালক্রমে লোকমুখে ‘শোভাবাজার’। সাধারণ মানুষদের মধ্যে, রাজবাড়ির জৌলুসের প্রভাবটাও স্পষ্ট হয় এই নাম থেকে।
নগেন্দ্রনাথ ঘোষ লিখেছিলেন, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক নবকৃষ্ণই। সাহেব-সুবো, বড়মানুষদের জন্য শোভাবাজারের রাজবাড়িতে বাইজি নাচের আসর বসত, জনসাধারণের জন্য হত কবিগান। কবিয়াল হরু ঠাকুর আর নিতাই দাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবকৃষ্ণ। ১৭৫৭ সালের দুর্গাপুজোয় ‘উইলসন’ নামের বিখ্যাত হোটেল থেকে খাদ্য আর পানীয় এসেছিল সাহেব অতিথিদের জন্য।
নবকৃষ্ণ দেবের দান-ধ্যানও ছিল, জঙ্গল পরিষ্কার করে বেহালা থেকে কুলপি পর্যন্ত ৩১ মাইল দীর্ঘ সড়ক বানিয়েছিলেন তিনি। মাদ্রাসা তৈরিতে এবং সেন্ট জোনের গির্জা নির্মাণেও সাহায্য করেছিলেন। জনকল্যাণমূলক নানা কাজেও তিনি দান করতেন।
বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই ছোট রাজা কালিকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ি, তিনি ‘রাজবাহাদুর’ উপাধিপ্রাপ্ত। শোভাবাজারের নাম নিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, এই অঞ্চলের আদিনাম ‘সুবাবাজার’। আরবি শব্দ ‘সুবহ্’ যার অর্থ রাজপুরুষ। সাহেব-সুবো কথাটির ‘সুবো’ এখান থেকেই আগত।
রাজা নবকৃষ্ণ দেব আরবি-ফার্সি-উর্দু আর ইংরেজিতে চোস্ত ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সি শিক্ষক ছিলেন তিনিই, আবার গভর্নর ড্রেকের দোভাষীও ছিলেন তিনি। হিন্দু বাড়ির পুজোয় ইংরেজদের আমন্ত্রণ ও আপ্যায়নের রীতিও কলকাতায় প্রথম তিনিই চালু করেছিলেন। তাই মনে করা হয় যে, নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে সাহেব-সুবোদের সঙ্গে এই নিবিড় ঘনিষ্ঠতা দেখেই হয়তো, এই অঞ্চলকে ‘সুবাবাজার’ বলে ডাকতে শুরু করেন তদানীন্তন কলকাতাবাসি এবং সেই থেকেই কালক্রমে মানুষের উচ্চারনের তারতম্যে আজকের শোভাবাজার নামের জন্ম হয়।