ধর্মতলা থেকে এগিয়ে চলেছেন কলকাতার দক্ষিণে, পৌঁছে যাবেন পার্ক স্ট্রিটে। এ শহরকে সাহেবিয়ানা দিয়েছে পার্ক স্ট্রিট। ক্রিসমাস থেকে ইংরেজি নতুন বছর, এই শহরকে ঝলমলে আলোর রাত দিয়েছে এই রাস্তা। অক্সফোর্ডের বইয়ের দোকান থেকে জায়কার কাঠি রোল, ছুটির পর জেভিয়ার্স থেকে ফ্লুরিসের ব্রেকফাস্ট, তিলোত্তমাকে সব দিয়েছে পার্ক স্ট্রিট।
জটায়ু তোপসেকে বলেছেন, "তপেস ভাই এ হল গোরস্থান, এখানে গোরাদের কবর দেওয়া হত।" সেই ফেলুদা সিরিজের 'গোরস্থানে সাবধান' এই গোরস্থান তো এখানেই। ট্রিংকাস, হ্যাঁ শহরের প্রথম দিকের নাইট ক্লাবও এখানেই। এই ক্লাব থেকেই তো উষা উত্থুপের পথ চলা শুরু।
প্রায় ২৫০ বছরের ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে এই শহরেই রয়েছে পার্ক স্ট্রিট। ১৭৬০ সালে, প্রথমবার এই রাস্তার কথা উঠে আসে সরকারি নথিতে। পরবর্তীকালে নানান সময়ের নথি দেখলেই বোঝা যায়, বিশেষ করে এই রাস্তাটির ক্ষেত্রে নাম বদল কোনও নতুন ঘটনা নয়, যেন জলভাত। যত আকারে আয়তনে বেড়েছে কলকাতা, তত বিবর্তন ঘটেছে পার্ক স্ট্রিটের।
১৮৫০ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডিকশনারি’ থেকে জানা যায়, এই রাস্তার তৎকালীন নাম ছিল 'গোরস্থান কা রাস্তা'। ঐ সময় যে রাস্তা দিয়ে যেখানে যাওয়া যেত, সেই অনুযায়ী নাম হত। এই নামেও সেই রীতিটি অনুসরণ করা হয়েছে।
অন্যমতে এই রাস্তার নাম ছিল 'Badamtallee’ (বাদামতলি)। ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সির গভর্নর হিসেবে ১৭৬০ সালে হেনরি ভ্যানসিটার্ট কলকাতায় আসেন। তাঁর ঠিকানা হয় ৫, মিডলটন রো-এর বেশ বড়সড় তিনতলা একটি বাড়ি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে সেই বাড়িটিই হয়ে যায় লরেটো হাউজ স্কুল, আজও সেটি স্কুলেরই অংশ। বাড়ির সঙ্গেই যুক্ত ছিল বিরাট এক বাগান এবং এই বাড়িতেই চার বছর থেকেছিলেন ভ্যানসিটার্ট।
যদিও এই বাগান বাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। এর মালিক ছিলেন উইলিয়াম ফ্রান্কল্যান্ড। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় তিনিই এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ভ্যানসিটার্টও এই বাড়িতে সারা জীবন থাকতে পারেননি। তিনি অবশ্য পালিয়ে যাননি, শাসনকালে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়, বাধ্য হয়েই ১৭৬৪ সালে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে এসে ওঠেন এলিজা ইম্পে, ফোর্ট উইলিয়ামের অধীনস্থ সেই সময়কার সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। শুধু এই পরিচয়ই নয়, তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন এলিজা।
এই এলিজা ইম্পেই বীরভূমের দেওয়ান মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসির হুকুম দেন। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন নন্দকুমার, যার প্রতিশোধস্বরূপ নন্দকুমারকে ভুয়ো মামলায় জড়িয়ে ফাঁসির ব্যবস্থা করেন হেস্টিংস। ইম্পে স্বয়ং নন্দকুমারকে দোষী ঘোষণা করেন। ১৭৭৫ সালে কলকাতায় ফাঁসি হয় নন্দকুমারের।
কিন্তু রেহাই পাননি দুই বন্ধুও, দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ আনেন টমাস ম্যাকলে, যার ফলে দীর্ঘ সাত বছরের অভিশংসন প্রক্রিয়া চলে হেস্টিংস এবং ইম্পের বিরুদ্ধে। শেষমেশ রাজনৈতিক কারণেই দুজনকে নির্দোষ ঘোষণা করে ব্রিটেনের হাউজ অফ কমনস।
মিডলটন রো-এর বাড়ির, সেই বড় বাগান বা ‘পার্ক’ থেকেই পার্ক স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদ পি থাঙ্কপ্পন নায়ার। এই ‘বাগান’ ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তৎকালীন কিছু নথি অনুযায়ী, বাগানটি মিডলটন রো থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল সেই রাসেল স্ট্রিটে, এবং এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমানে রাসেল স্ট্রিটে অবস্থিত রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের জমিটিও।
কিছু কিছু নথিতে, বাগানে হরিণ ঘুরে বেড়ানোর উল্লেখ রয়েছে, যে কারণে এই বাগানকে নাকি ‘ডিয়ার পার্ক’ বলা হত। যদিও এর নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ এখন আর পাওয়া যায় না। আবার অনেকেই বলেন, ইম্পে এখানে থাকাকালীন নাকি হরিণ পুষেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই রাস্তার নাম হয়েছে বাদামতলি, ভ্যানসিটার্ট অ্যাভিনিউ, বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড এবং বেরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট। ভারতপ্রেমী জার্মান পণ্ডিত হেনরি ফারডিনান্ড ব্লখম্যান, যিনি ১৮৬০-এর দশকে কলকাতায় ফারসি ভাষা পড়াতেন, তিনি তাঁর ‘Calcutta During Last Century’ বইটিতে লিখেছেন যে, অতীতে পার্ক স্ট্রিটের নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট, এবং “গোটা দশেক” বাড়ি ছিল তার দুধারে।
কলকাতার একটি মানচিত্র তৈরি হয় ১৭৯৪ সালে, সৌজন্যে এ আপজন, যাতে পার্ক স্ট্রিটের উল্লেখ রয়েছে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড হিসেবে, কারণ এই পথ দিয়েই সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে যেতে হত। এই গোরস্থান চালু হয় ২৫ আগস্ট, ১৭৬৭ সালে। যে কারণে বহুদিন পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে কেউই বাড়ি কিনতে চাইতেন না। সাউথ পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও এই এলাকায় ছিল নর্থ পার্ক স্ট্রিট, মিশন এবং টেরিটি গোরস্থান। কালের নিয়মে আর কবর দেওয়া হয় না এখানে।
আজ যা এপিজে স্কুল, তার ভিতের নীচে রয়েছে এককালের ফরাসী গোরস্থান, এবং অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চের টাওয়ারটি দাঁড়িয়ে রয়েছে নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের ওপরেই। এই গোরস্থানের একমাত্র দৃশ্যমান স্মৃতিচিহ্ন হলো রবার্টসন মনুমেন্ট, যার নীচে রয়েছে রবার্টসন পরিবারের একাধিক কবর। এই পরিবারের অনেক সদস্য একসময় কলকাতা পুলিশে চাকরি করেছেন। ইতিহাসবিদদের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগসূত্রই সম্ভবত এই মনুমেন্টের অক্ষত থাকার কারণ।
কিন্তু কবে যে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট, তা সঠিক জানা যায় না! ইম্পে’র ‘ডিয়ার পার্ক’ থেকেই যদি এই নামকরণ হয়ে থাকে, ধরে নেওয়াই যায় যে ১৭৬০-এর দশকে এর নাম পাল্টে যায়। শহরের পুরনো নথি ঘাঁটলে জানা যায়, ১৯২৮ পর্যন্ত চৌরঙ্গী থেকে লোয়ার সার্কুলার রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পার্ক স্ট্রিট। সে বছর কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট রাস্তা বাড়াতে শুরু করে, একেবারে চার নম্বর ব্রিজের রেল লাইন অবধি রাস্তা বাড়ানো হয়। এই রাস্তা বাড়ানোর কাজ শেষ হয় ১৯৩৪ সালে।
এককালে যতই গোরস্থানের আধিপত্য থেকে থাকুক, কালক্রমে পার্ক স্ট্রিট হয়ে ওঠে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলির অন্যতম, যার দু-ধারে গড়ে ওঠে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, ফ্রিমেসনস হল, এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের মতো প্রতিষ্ঠান, সঙ্গে অজস্র উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসভবন। তবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিকীকরণের ঠেলায় ক্রমাগত ভাঙা হয়েছে ঐতিহ্যের পার্কস্ট্রিটের পুরনো বাড়ি, বদলে গেছে স্থাপত্য।
২০০৪ সালে পার্ক স্ট্রিটের নাম ফের পরিবর্তন করে মাদার টেরেসা সরণী রাখা হয়।