* নতুন দেশ *
নদীর ঘাটের কাছে
নৌকো বাঁধা আছে,
নাইতে যখন যাই দেখি সে
জলের ঢেউয়ে নাচে।
আজ গিয়ে সেইখানে
দেখি দূরের পানে
মাঝ-নদীতে নৌকো কোথায়
চলে ভাঁটার টানে।
জানি না কোন্ দেশে
পৌঁছে যাবে শেষে,
সেখানেতে কেমন মানুষ
থাকে কেমন বেশে।
থাকি ঘরের কোণে,
সাধ জাগে মাের মনে
অম্নি ক’রে যাই ভেসে ভাই
নতুন নগর বনে।।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আমার দেশ ভারতবর্ষ একটা নদীমাতৃক দেশ। আর আমাদের দেশের বা আমাদের রাজ্যের অথবা আমার নিজের শহর কলকাতার প্রধান নদী কোনটা আপনারা বলুন তো? ঠিক কথা... গঙ্গা! যদিও গঙ্গা সেই হিমালয়ের গোমুখে গঙ্গোত্রি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এই তিন রাজ্য দিয়ে বয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান -এর কাছে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা ভাগ চলে গেছে বাংলাদেশে পদ্মা নাম নিয়ে আর আরেকটা ভাগ ভাগীরথী নাম নিয়ে চলে এসেছে নদিয়ার নবদ্বীপ পর্যন্ত তারপর হুগলি নদী নাম নিয়ে কলকাতা আর হাওড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে সোজা চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে। এই ভাগীরথী হুগলি... আমরা তাকে গঙ্গা বলতেই ভালবাসি। আর এই হুগলি (গঙ্গা) নদীর পূর্ব তীরেই গড়ে উঠেছিল আমার প্রাণের শহর প্রিয় শহর কলকাতা।
এক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নগরী ছিল কলকাতা। তখনও তো ট্রেন সার্ভিস চালু হয়নি। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অথবা যাতায়াতের জন্য জলপথই ছিল প্রধান। জলপথ মানেই হুগলি গঙ্গা আর এই জলপথে যে নৌকা বা জাহাজ চলাচল করতো সেইগুলো এসে যখন কলকাতায় পৌঁছত তাদের নদীতীরে ভিড়বার জন্য তৈরি হয়েছিল অনেকগুলো ঘাট। ইংরেজরা এই দেশে আসার আগেই কিন্তু কলকাতায় এসেছিলেন আর্মেনিয়ানরা। তারাও তাদের ব্যবসার সুবিধার জন্য হুগলি নদীর তীরে ঘাট তৈরি করে নিয়েছিলেন।
ইংরেজরা যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপন করল তার প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতায়। তখন ইংল্যান্ড থেকে জাহাজগুলো জলপথে এসে কলকাতাতেই হুগলি নদীর তীরে ভিড়ত। এছাড়াও প্রচুর মানুষ তীর্থস্থান হিসেবেও কলকাতায় বেড়াতে আসতেন কারণ কলকাতাতে ছিল বা আছে কালীঘাট। যেই কালীঘাটের কালীবাড়িতে, মনে করা হয়, দেবী গৌরীর একটি অঙ্গ পতিত হয়েছিল। তাই কালীঘাট হিন্দুদের কাছে একটি অতি পবিত্র তীর্থভূমি। এই কালীঘাট দেখতেও মানুষজন নৌকা করেই কলকাতায় আসতেন। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের কাছে গঙ্গা একটি অতি পবিত্র নদী।
গঙ্গাস্নানকেও হিন্দুরা অত্যন্ত পবিত্র কাজ বলে মনে করে। এইসব কারণে কলকাতার হুগলি গঙ্গার তীরে অনেকগুলি ঘাট তৈরি হয়েছিল, যে ঘাটগুলোর কোনো কোনোটার বয়স হয়তো তিনশো বা তারও বেশি। এই ঘাটগুলির মধ্যে অনেকগুলো ঘাটের সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা বা অনেক বিখ্যাত মানুষের নামও জড়িয়ে আছে। যেমন রানী রাসমণি, শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী সারদা মা, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসব, কলকাতায় প্রথম সুপ্রীমকোর্ট তৈরি হওয়া... আরো কত...
এই হুগলি গঙ্গার তীরের কয়েকটা ঘাটের ইতিহাস নিয়েই লিখব "ঘাটোদ্ঘাটন"...যে ঘাটগুলির নাম কলকাতা শহরের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উদঘাটন মানে তো আমরা সবাই জানি... খুলে দেওয়া... উন্মোচন করা। এই ঘাটগুলির ইতিহাস উন্মোচিত হবে কয়েকটি পর্বের লেখায়... চলুক তাহলে ঘাট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি.. আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে...