সন্তোষী মা হলেন মনোবাঞ্ছা পূরণের দেবী, মনোবাসনা পূরণ করতেই দেবী ব্রত পালন করেন ব্রতীরা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করা হয়, সন্তোষী মায়ের জন্মবার হল শুক্রবার। তাই দেবীর ব্রত উদযাপনের জন্যে ঐ দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। বাড়ির মহিলারাই এই ব্রত পালন করেন। বছর জুড়ে একটানা ১৬টা শুক্রবার ব্রতের নিয়ম পালন করলেই সন্তোষী মায়ের ব্রত উদযাপন হয়।এই ব্রত পালনের মাধ্যমে মা সন্তোষী সন্তুষ্ট হন বলে ব্রতীরা বিশ্বাস করেন। প্রতি শুক্রবার উপবাসে থেকে স্নান করে শুদ্ধবস্ত্রে সন্তোষী মাতার পুজো করতে হয়। দেবীর আরাধনার সময় প্রদীপ দিয়ে আরতি করতে হয়, ধুপ ধুনো জ্বালাতে হয়। এই ব্রতে কোনও তিথি নক্ষত্রের বিধিনিষেধ নেই।
মনে করা হয় যেসব নারীরা ভক্তিভরে এই ব্রত উদযাপন করেন, সেইসব নারীরা জীবনে কোনদিন বৈধব্য যন্ত্রণা পায় না। তাঁদের সকল মনােবাসনা পূর্ণ হয়। তারা সারাজীবন স্বামী-পুত্র ও পরিজনবর্গসহ সুখে-স্বাচ্ছন্দে কাল কাটায়। তাদের গৃহে অর্থাভাব হয় না। যে কোনও বয়সের পুরুষ ও নারী এই ব্রত করতে পারে। এই ব্রত পালনের জন্য বিশেষ কিছু খাওয়ার বিধিনিষেধ রয়েছে। ব্রত পালনের দিন টক দ্রব্য খাওয়া নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ব্রত পালন করলে শুক্রবারে একেবারেই টক খাওয়া যাবে না। নিরামিষ আহার করতে হয়। দেবীকে ছোলা-গুড় নিবেদন করা হয়। ধান, দূর্বা, ফুল, বেলপাতা,বাতাসা অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করা হয়।
যে মনোকামনা পূরণের জন্য ব্রত পালন করা হচ্ছে তা পূরণ হয়ে গেলেই ব্রত শেষ, তখন উদযাপন আয়োজন করা হয়। বালক ভোজন করানো হয়। ব্রতী, আট জন বালককে বাড়িতে ডেকে খাওয়ান, তাদের ফল-মিষ্টি- দক্ষিনা-উপহার দান করেন। ছোলা শাক-তারকারি-লুচি দেবী ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। বালকদেরও লুচি খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে।
মা সন্তোষী প্রণাম মন্ত্র হল, 'সর্বমঙ্গলা মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহ'স্তুতে।' যার অর্থ হে দেবী,তুমি মঙ্গলের মঙ্গল রূপিণী,কল্যাণময়ী সর্বাভীষ্টপূরিকী, সকলের আশ্রয় সরূপিণী ও ত্রিনয়না।
হে গৌরী, হে মাতা তোমাকে প্রণাম।
মায়ের ব্রতকথার প্রচলন নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে। একদা এক সময় কোনাও এক মহিলা বাস করতেন, যার ওপরে তাঁর শাশুড়ি মা নানা ভাবে অত্যাচার করতেন। শাশু়ডি মায়ের সব রকম অত্যাচার ও খারাপ ব্যবহার মুখ বুজে সহ্য করতেন ওই মহিলা। কারণ তিনি তাঁর স্বামীকে খুবই ভালোবাসতেন।
কিছুদিন পরে ওই মহিলার স্বামীকে কর্মসূত্রে অন্যত্র যেতে হয়। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে ওই মহিলার শাশুড়ি মা পুত্রবধূর ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ওই মহিলা একটি মন্দিরে যান, সেখানে তিনি সন্তোষী মায়ের ব্রতকথার বিষয়ে জানতে পারেন। এরপরই তিনি পরপর ১৬টি শুক্রবার ধরে উপবাস রেখে সন্তোষী মায়ের ব্রত পালনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম শুক্রবার ব্রত পালন করার পরেই তিনি শাশুড়ি মায়ের ব্যবহারে পরিবর্তন টের পান। তাঁর স্বামীও বিদেশ থেকে তাঁকে চিঠি ও টাকা পাঠান।
এক একটা করে শুক্রবার সন্তোষী মায়ের ব্রত পালন করে কাটাতে থাকেন তিনি, আর তাঁর জীবনেও পরিবর্তন আসতে থাকে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর স্বামীর উপার্জন অনেকটাই বেড়ে যায়। তাঁদের বেশ কিছু টাকা সঞ্চয়ও হয়ে যায়। স্বামী ফিরে আসার পর ১৬টি শুক্রবার সম্পূর্ণ হলে উদ্যাপনের মাধ্যমে ব্রত উদযাপনের আয়োজন করেন ওই মহিলা।
কিন্তু তাঁর শাশুড়ি মোটেও চাননি যে তিনি সফল ভাবে সন্তোষী মায়ের ব্রত উদযাপন করতে পারেন। সেই কারণে যে আটটি ছেলেকে তিনি খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তাঁদের তিনি টক খাবার খাইয়ে দেন। সন্তোষী মায়ের ব্রত উদযাপন টক খাবার খাওয়ানো একেবারেই বারণ।
সন্তোষী মায়ের ব্রত সঠিক ভাবে উদযাপন করতে না পারায় ওই মহিলার স্বামীর বড় ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু এরপর তিনি ব্রত উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। এবার কোনও রকম সমস্যা ছাড়াই নিষ্ঠাভরে ব্রত উদযাপন করতে পারেন তিনি। ওই মহিলার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে মা তাঁকে আশীর্বাদ করেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সন্তোষী মায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেন তাঁর শাশুড়ি মা। এইভাবেই সন্তোষী মায়ের ব্রত কথার প্রচলন শুরু হয়।
মায়ের ব্রতকথা
এক বণিক করিত বাস কোন এক গ্রামে।
সাতপুত্র ও পত্নী রাখি গেল স্বর্গধামে।।
ছয় ভাই কর্ম করে আনন্দিত হয়ে।
অর্থ যাহা পায় তাহা আনি দেয় মায়ে।।
ছােটছেলে রামুর ছিল বেকার জীবন।
করিতে না পারে কিছু অর্থ উপার্জন।।
সাবিত্রী নামেতে ছিল রামুর রমণী।
সতী সাধ্বী পতিব্রতা স্বামী সােহাগিনী।।
বিবিধ সুখাদ্য মাতা করিয়া রন্ধন।
আগে দিত ছয় পুত্রে করিতে ভােজন।।
ভাইদের উচ্ছিষ্ট রামুকে খেতে দেয়।
বধুদের উচ্ছিষ্ট লয়ে সাবিত্রীকে দেয়।।
একদা সাবিত্রী তার স্বামীর গােচরে।
সব কথা জানাইল ব্যথিত অন্তরে।।
পরীক্ষা করিয়া রামু জানিতে পারিল।
সব সত্য কথা যাহা সাবিত্রী বলিল।।
বুঝিতে পারিল রামু অর্থ নাহি যার।
এ সংসারে জন্ম বিফল হয় তার।।
বিদেশে যাইব রামু সাবিত্রীরে বলে।
শুনিয়া সাবিত্রী তাহা ভাসে আঁখিজলে।।
দেশে দেশে ঘুরি রামু এক দেশে এল।
ধনী সদাগর সঙ্গে তার দেখা হল।।
রামুকে সে সদাগর চাকুরী যে দিল।
রামুর বুদ্ধিতে ব্যবসা প্রচুর বাড়িল।।
ব্যবসায় অংশীদার রামুকে করিল।
ক্রমশঃ উন্নতি তার হইতে লাগিল।।
প্রত্যেক মাসেই রামু সাবিত্রীর নামেতে।
পাঠাতে লাগিল টাকা আপনবাড়ীতে৷৷
সেই টাকা সাবিত্রী কখনাে নাহি পেত।
ছয় ভাই সে টাকা গােপনে লইত।।
ছ' জায়ের কথামত সাবিত্রী খাটিত।
তবুও সে পেট ভরে খেতে নাহি পেত।।
শাশুড়ীর অত্যাচার নাহি আর সয়।
কাষ্ঠলাগি রােজ তারে বনে যেতে হয়।।
একদিন নিদ্রা তার আসে আচম্বিতে।
জ্যোতির্ময়ী দেবী এক দেখিল স্বপ্নেতে।।
বলে আমি মা সন্তোষী পূজা কর মােরে।
তার ফলে দুঃখ কষ্ট সব যাবে দূরে।
পতি ফিরে পাবে বলি অন্তর্ধান কৈল।
স্বপ্নভঙ্গে সাবিত্রী যে উঠিয়া বসিল।।
মন্দির দেখি সাবিত্রী সেই স্থানে যায়।
দেখে স্বপ্নে দেখা দেবী বিরাজে তথায়।।
ব্রতবিধি জানিয়া সাবিত্রী ব্রত করে।
সন্তোষী মা প্রসন্না হলেন তার পরে।৷
হেথা স্বপ্নাদেশ দেবী করেন রামুরে।
শীঘ্র করি ওরে রামু ফিরে যাও ঘরে।।
দেবীর আদেশে রামু দোকানেতে গেল।
সেই দিন লাভ তার দশগুণ হল।।
বহু অর্থ লয়ে রামু ফিরে আসে ঘরে।
ভক্তিভরে প্রণাম সে করিল মাতারে।।
পত্নীরে দেখিয়া রামু হইল বিস্মিত।
পত্নীমুখে সব শুনি হইল দুঃখিত।।
রামু ও সাবিত্রী পূজে সন্তোষী মাতারে।
ধনৈশ্বর্য তাহাদের দিনে দিনে বাড়ে।।
ব্যবসা করিয়া রামু উন্নতি করিল।
যথাকালে তাহাদের এক পুত্র সন্তান হল।।
ছয় ভাই ছয় জায় মন্ত্রণা করিল।
রামুকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টা কৈলসত্তোষী মাতার কৃপা ছিল তার পরে।
সে কারণে ক্ষতি কেহ করিতে না পারে।।
সন্তোষী মাতার ব্রত করে যেই জন।
ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করে সেই জন।।
টক দ্রব্য শুক্রবারে কভু না খাইবে।
সন্তোষী মাতার কৃপা অবশ্য পাইবে।।
সন্তোষীর ব্রতকথা হৈল সমাপন।
উলুধ্বনি দাও সবে যত বামাগণ।।
জয় জয় সন্তোষী মাতা তুমি গাে কল্যাণী।
তােমার কৃপায় সব সুখী হয় জানি।।
-অথ শ্রীশ্রীসন্তোষী মাতার ব্রতকথা সমাপ্ত