দাবদাহে পুড়ছে বাংলা, একটু বৃষ্টির আশায় সকলে। বাংলার সংস্কৃতি, লোকাচারে মিশে রয়েছে বর্ষার প্রার্থনা। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেই গিয়েছেন, 'চাতক বারি যাচে রে? সে আমাদের বাংলা দেশ, আমাদেরই বাংলা রে!' চাতক জল চায় এ'দেশে। বৃষ্টির প্রার্থনায় লোকজ ছড়ায় বাচ্চারা বলে ওঠে -
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে
আব্বাসউদ্দিনের গানেও ধরা দেয় বৃষ্টির জন্য আর্তি - আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই।
তীব্র গরম পড়লেই গ্রাম-গঞ্জে শুরু হয় ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া, বিশ্বাস করা হয় মিলনে বৃষ্টি আসবে। রীতিমতো লোক পাত পেড়ে খান। গান অবধি গাওয়া হয়,
ব্যাঙা-ব্যাঙির বিয়ে, কুলো মাথায় দিয়ে
ও ব্যাঙ জল আন গিয়ে আন গিয়ে
খালেতে নাই জল
বিলেতে নাই জল
আকাশ ভেঙে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল।
গোটা বাংলায় বহু রীতি দেখা যায়, বৃষ্টি কামনায় তা পালন করা হয়। মালদহে বৃষ্টির কামনায় গাছহিংড়ি প্রথা পালনের রেওয়াজ রয়েছে। মামার বাড়িতে জন্ম হয়েছে, এমন একটি বাচ্চা ছেলে উলঙ্গ হয়ে, সবার অগোচরে একটি গাছের কাণ্ডে ছোট্ট কুঠুরি তৈরি করে সেখানে হিং ভর্তি করে দেয়। লোকবিশ্বাস মতে, এতে বৃষ্টি নামে।
নোড়াপোঁতা বলেও একটি রেওয়াজ দেখা যায়; পাড়ার সবথেকে ঝগড়ুটে মহিলার বাড়ি থেকে চুরি করে আনা নোড়া পুঁতে দেওয়া হয় অন্য বাড়ির উঠোনে। সকলের বিশ্বাস, নোড়া না পেয়ে মহিলা ঝগড়া করলেই মেঘ রেগে গিয়ে বৃষ্টি দেবে।
বরুণদেবকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে সাতঘরিয়া খেলায় মেতে ওঠে কোনও কোনও এলাকা।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি নামানোর জন্য মেঘপরব বা হুদুমদেও পুজো করা হয়। আদপে মেঘের পুজো করা হয়। নির্জনে, রাতের অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে পুজো শুরু করেন মেয়েরা। ফিঙে পাখির বাসা, কলাগাছ, জল ভর্তি ঘট, কুলো, পান-সুপারি, বরণ ডালা, ধুপ এবং পুজোর নানাবিধ সামগ্রী নিয়ে পুজোর আয়োজন করা হয়।
মেয়েরা গেয়ে ওঠেন,
'হুদুমদেও হুদুমদেও, এক ছলকা পানি দাও
ছুয়ায় অশুচি আছি, নাই পানি
ছুয়াছুতির ধারা বাহি ঝালকানি।
কালা ম্যাগ, উতলা ম্যাগ, ম্যাগ সোদর ভাই
এক ঝাঁক পানি দাও গাও ধুইবার চাই।'
এছাড়াও রয়েছে ব্রত। কুলো নামানি ব্রত, গ্রাম বাংলায় বৃষ্টির জন্য কৃষকেরা এক লোকজ প্রথা পালন করে। নতুন একটি কুলোয় ধান, বিভিন্ন বনফুল, দূর্বা এবং কাকের বাসার খড় দিয়ে গ্রামের কোনও এক কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সেই কুলো তুলে দেওয়ার আগে একটি কাঁসার জল ভর্তি কলসির উপর কুলো রাখা হয়। বৃষ্টি নামানোর জন্য প্রার্থনা করে ব্রতর ছড়া গান গাওয়া হয়। বৃষ্টির কামনা করে বাংলার গ্রামে গ্রামে বসুধারা ব্রত পালনের রেওয়াজ ছিল।
আলপনায় আটটি তারা এঁকে, আটটি ফুল দিয়ে মেয়েরা মন্ত্র পড়ত-
অষ্টবসু অষ্টতারা তোমরা হলে সাক্ষী
আট দিকে আট ফুল আমরা রাখি।
মাটির ঘটে ছিদ্র করে বৃষ্টির অনুকরণে গাছের মাথায় জল ঢেলে গঙ্গা বরুণ ইন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ দেবতার কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা জানাত ব্রতীরা।
গঙ্গা গঙ্গা ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ বাসুকি,
তিন কুলে ভরে দাও ধনে জনে সুখী।
গ্রামবাংলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে পুণ্যিপুকুর ব্রতও পালিত হয়। পুণ্যিপুকুর ব্রতের জন্য গৃহস্থ বাড়ির প্রাঙ্গণে গর্ত করে ছোট পুকুর কেটে কড়ি দিয়ে চারটে ঘাট সাজানো হয়। এরপর সাদাফুল, চন্দন, দূর্বা, কাঁটাসহ বেলগাছের ডাল ও তুলসি গাছ পুকুরে পুঁতে পুকুর জল ঢেলে পূর্ণ করা হয়। বাড়ির উঠোন ছাড়াও পুণ্যিপুকুর ব্রত পুকুরপাড়ে এবং বাগানে পুকুর কেটে পালন করা হয়।
পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা
কে পূজে রে দুপুরবেলা?
আমি সতী লীলাবতী
ভাইয়ের বোন পুত্রবতী,
হয়ে পূত্র মরেব না
পৃথিবীতে ধরবে না।
যাবতীয় আচারের নেপথ্যে থাকে প্রকৃতি শীতল হওয়ার আর্তি, বৃষ্টির প্রার্থনা।