আঠেরো নম্বর ইন্দ্রানী পার্কের জগজ্জননী ঋতুপর্ণ’র মা

নশ্বর জীবনের রেখায় আজ ষাট পূর্ণ করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। কিন্তু থেমে যাওয়া আয়ুরেখা তাঁকে উপহার দিয়েছে অক্ষয় জীবন। প্রতি শরতে  সহস্র পরমান্নের সুখে ভরে ওঠে জীবনের স্বাদ। যে জীবন সীমার গন্ডি পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছে অসীমে।

তিনি ছিলেন আমাদের এই কলকাতা শহরের মানুষ। ভারী আপনার জন। সুখে, দুখে, বিষাদ কান্না জুড়ে তাঁর বয়ে চলা। তাই ‘অতীতকাল’র ক্রিয়াপদ তাঁর নামের সঙ্গে জুড়তে ঠিক হাত সরে না বাঙালির। এ যেন ঠিক পাশের বাড়ির মানুষটা। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে, বাড়ির ছাদে দাঁড়ালেই ঠিক দেখা হয়ে যায়। হেঁশেলের খুঁটিনাটি, সুখ-অসুখের একান্ত ব্যক্তিগত বলে ফেলা যায় উজাড় করে। কোথাও এতটুকু বাধো-বাধো ঠেকে না। এই মানুষটি এমনই ঘরের লোক!

IMG-20230831-WA0015

জন্মদিন এলে মায়ের কথা মনে পড়ে। ঘিয়ে ভরা প্রদীপ জেগে উঠেছে সোনালী আলোয়। প্রদীপের পাশে পঞ্চব্যঞ্জন। সামনে রাখা পরমান্ন বাটি। ধূপ চন্দনে চলে জন্মদিনের উদযাপন। এ জন্মদিন যে মায়েরও জন্মদিন। মা হয়ে ওঠার উদযাপন।

মায়ের কথা বারবার এসেছে তাঁর কলমে। বাংলা সংবাদ পত্রে এক রবিবাসরীয় ম্যাগাজিনের সম্পাদক ঋতুপর্ণ। কলম লিখতেন ‘ফার্স্টপার্সন’। সম্পাদকীয় লেখার চেনা ছক ভেঙ্গে চুরমার করে দিতেন ফি রোব্বার। অবলীলায় ঢুকে পড়তেন বৈঠকখানা, বইঘর পেরিয়ে এক্কেবারে অন্দর মহলে।  সমকাল, সমাজ, রাজনীতি পেরিয়ে ছোট বড় দুঃখ সুখ বিষাদ সব থাকত। নিজের কথার সঙ্গে থাকত মায়ের কথা। তাঁর কলম দিয়েই ঋতুপর্ণ ঘোষের মা ইরা ঘোষ আর সুনীল ঘোষকে চিনতে শিখেছিল বাঙালি। তাঁর বাবা-মা দুজনেই ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী। সেখানেই পড়াশোনা,প্রেম। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর বিয়ে করেন।

IMG-20230831-WA0016

ঋতুপর্ণ লিখতেন বাড়ির কথা। পরিবারের কথা। তার সিংহভাগ জুড়ে থাকতেন তাঁর মা। কখনও মাতৃভাষা, কখনও মা দুগগা আর কখনও আঠারো নম্বর ইন্দ্রানী পার্কের মা জননী মিলে মিশে যেতেন ফার্স্টপার্সনের সম্পাদক কলমে। মায়ের কথা লেখার সময় যেন মাটি হয়ে যেতেন ঋতুপর্ণ। তখন কে বলবে তিনি বাংলা তথা ভারতীয় ছবির দোর্দণ্ডপ্রতাপ পরিচালক। বিজ্ঞাপন দুনিয়ার ধারা বদলে দেওয়া বাঘা কপিরাইটার। কড়া সম্পাদক! তারবদলে পাঠকের চোখের সামনে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে এক নরম শিশু। মায়ের আদর আর কোল জুড়ে থাকার আকাঙ্খা যেন তার জীবনের একমাত্র চাওয়া। তার কাছে ফিকে হয়ে যায় হইচই, নাম ডাক।

ঋতুপর্ণ লেখেন আনন্দ, বেদনা, একাকিত্ব যাপনের কথা। কাঁটার পথে বারবার কাতর বাক্যে খুঁজে চলেন মাকে। তাঁর হার কিংবা জিত সবকিছু জুড়ে সেই মাতৃমুখ। তিনি বলেন,    ‘৩৭৭ ধারা নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। তাঁরা এখন অন্য জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের ক্যামেরায় তাই হয়ত ধরা পড়ল না আরেকজন প্রৌঢ়ার ছবি- আমার মা।

কিন্তু আমি মনে মনে জানি অন্তরীক্ষ বলে যদি কোনও নিঃসীম পথ থাকে সেখানে ক্লিষ্ট পায়ে অশক্ত দূর্বল হাতে PROUD MOTHER প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটে চলেছে আমার মা।

আমার সব নিভৃত নিঃসঙ্গ বিজয়মিছিলের সঙ্গী’।

 মায়ের সঙ্গে কেমন ছিল তাঁর দিন? একেবারে ছোটবেলায় ঘুমপাড়াতে গিয়ে ‘গান’ গাইতেন মা। কিন্তু তাঁর  মা গান গাইতে পারতেন না। তাই সঞ্চয়িতা পড়ে পড়ে ঘুম পাড়াতেন তাঁকে। সেই প্রথম তাঁর রবীন্দ্রনাথে হাতেখড়ি।

তাঁর মা ছিলেন ছবি আঁকিয়ে। কিন্তু পুত্রের ছোটবেলায় মায়ের শিল্পী পরিচয় প্রছন্ন ছিল। একদিন সামনে এল সেই দিকটি। তাঁর নিজের কথায়,  ‘একদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে হোমওয়ার্ক করছি। আর সামনে বসে আমারই একটা পুরনো খাতার পেছনের পাতায় আঁকিবুঁকি কাটছে মা। ঝুঁকে দেখি মা স্কেচ করছে’।

সেদিন শিখেছিলেন একটা তিন ব্লেডের পাখা কীভাবে ফুল হয়ে ওঠে।

মায়ের মৃত্যু তাঁকে এক অন্য জীবনের পাঠ দিয়েছিল। লিখেছিলেন,   ‘মা চলে গিয়ে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিয়ে গেল।

মা’রা আসলে অমর। আর মা ছাড়া বাবারা বড্ড অসহায়’।

মায়ের গল্প আর তাঁর দিনপ্রতিদিন পড়তে গিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না পাঠকের কেন ঋতুপর্ণর ছবির নারী চরিত্ররা অন্যরকম। এক রোব্বার তিনি লিখেছেন,

“ ছোটবেলায় জানতাম মা’র আদরে আমার ভাগীদার কেবল আমার ভাই চিঙ্কু। পরে বুঝলাম আরও দুজন আছে।

মা’র ড্রেসিং টেবিলের দুটো জিনিস।

মার চুল বাঁধার কালো দড়ি। সন্ধেবেলা বাড়ি থাকলে গা ধুয়ে একটা বড়ি খোঁপা বাঁধত মা। আমার মতো গরমের বাতিক ছিল মারও- চুলটাকে টেনে ছোট্ট করে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি হত না।

একটালম্বা ট্যালকম পাউডারের কৌটো ছিল-খালি। মাঝে মাঝে পিঠে যখন খুব ব্যথা করত, পিঠের তলায় পাউডারের কৌটো রেখে শুত না।

ওই চুল বাঁধবার দড়ি আর কৌটো যেন মার আর দুটো ছেলে। চিঙ্কু আর মার মতোই ওরা যেন সারাজীবন মা’র আদর পেয়েছে। আমরা যখন বড় হয়ে মা’র কোলছাড়া হয়েছি তখনও ওরা নিয়মিত পেয়েছে মায়ের শরীরের উত্তাপ, মার সেই গায়ের গন্ধ যেটা নিকষ অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকেও কেবল একটাই শব্দ হয়ে জাপটে ধরে-মা।”

বয়স বেড়েছে। পরিসর বেড়েছে। পরিচিত দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম ক রেছে, তবু মা তাঁর পৃথিবী। গন্ধ মানে মায়ের গন্ধ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ হেমন্ত সব ঋতুতে জুড়ে থাকে।

একবার দুর্গাপুজোইয় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন মা। সেই তাঁর মায়ের শেষ পুজো দেখা। ম্যাডক্স স্কোয়ারে প্যান্ডেল অব্ধি গাড়ি যায় না। পার্কের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলচ্ছক্তিহীন, পঙ্গু মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিমার কাছে।  

সেদিন বিজয়া দশমী। সিঁদুর খেলা চলছে প্যান্ডেল জুড়ে।

সিনেমার কাজে বম্বে গিয়েছিলেন একবার। কাজ মিটিয়ে কলকাতায় রওনা হওয়ার আগে কথা হয়েছিল মা’র সঙ্গে।

ঠিক সময়েই ছাড়ছে প্লেন। সাতটা নাগাদ এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাতে হবে।

মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছেলেকে ‘কী খাবি রাত্তিরে? ভাত ভাত করে রাখব?’

বাড়ি ফিরে আর খাওয়া হয়নি। ফেরার পথে গাড়িতে জেনেছিলেন ‘মা মেই’

মা গেছেন তিনি তখন মাঝ আকাশে। বাড়ি ফিরে দেখলেন নিজের বিছানায়, নিজের বালিশে চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন মা। মাথায় এক মা সিঁদুর।

মা’র দিকে গাল বাড়িয়েছিলেন পুরনো অভ্যাসে। বাইরে থেকে ফিরলে যেমন আগেও প্রতিবার দিতেন। বিয়াল্লিশ বছরের পুরনো অভ্যাসে। এই প্রথম আর হামি এল না মায়ের থেকে।

ঋতুপর্ণ মনে পড়ে গিয়েছিল ম্যাডক্সের প্যান্ডেলে সেবারের সিঁদুর খেলার কথা। সেদিন খেয়াল করেননি। কিন্তু মায়ের বিদায়ের দিনে হঠাৎ মনে হয়েছিল সেই শেষবারের দেখায় মা দুগগা যেন কখন দশ হাত মুঠো করে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল মাকে।

নিস্তেজ অন্ধকারের মধ্যে মাতৃহারা ঋতুপর্ণর মনে হচ্ছিল দিনটা যান বিজয়া দশমী। দুগগা বিসর্জনে চলেছেন। শ্মশানের চুল্লির দরজাটা খুলতেই সমবেত হরিবলের মধ্যে থেকে কে যেন বলে ওঠে- দুগগা দুগগা...

অন্ধকার বাবুঘাটে মায়ের অস্থি নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা দুই ভাই। সামনে ছলছলে গঙ্গা। মাকে ভাসান দিচ্ছে তাঁর ভাই। তাঁর বলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ‘সাবধানে নামিস’। পরে মুহূর্তেই মনে হয়েছিল আর কোনও ফাঁড়া বিপদ নেই। মায়ের রোগশয্যার সব উৎকন্ঠা নীলকণ্ঠ পাখির ডানায় ভর করে মিলিয়ে গেছে আকাশে। সেদিন থেকে যে কোনও বিপদ আর অন্ধকারে দশহাত আর মাথা ভরা লাল টুকটুকে সিঁদুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঠেরো নম্বর ইন্দ্রানী পার্কের জগজ্জননী। ঋতুপর্ণ’র মা।

 

তথ্যঋণঃ ফার্স্ট পার্সন প্রথম খন্ড

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...