মানুষের জন্য যেমন ইতিহাস, তেমনই আপন কর্মশক্তির মাধ্যমে ইতিহাসের জন্যও প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেন বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব। সেরকমই ইতিহাসের এক প্রয়োজনীয় ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব - 'বিপ্লবী' বিনোদ বিহারী চৌধুরী। তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিপ্লবী’ বিশেষণটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তিনি। আজীবনই তিনি ছিলেন সংগ্রামী, সদা সত্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়নিষ্ঠ এবং বিবেকের কণ্ঠস্বর – সব মিলিয়ে এক মহৎ মানুষ, চির বিপ্লবী। নিতান্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেও কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায় তারই এক বিরল দৃষ্টান্ত 'বিপ্লবী' বিনোদ বিহারী চৌধুরী। আজ ১০ এপ্রিল, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।
বিনোদ বিহারীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। ১৯২৯ সালে সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। লাভ করেন রায় বাহাদুর বৃত্তি। স্কুল জীবনেই বিপ্লবী যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হন। এসময় তিনি সংস্পর্শে আসেন মাস্টারদা সূর্য সেনের এবং সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে মাস্টারদার বিপ্লবী বাহিনি ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনির মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে অনেক বীর বিপ্লবী শহীদ হন। বিনোদ বিহারীর কণ্ঠনালীতে গুলি লাগে। গোপনে তাঁকে চিকিৎসা নিতে হয়। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ভারতের রাজপুতনা দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাস করেন। ইংরেজ সরকার কর্তৃক গৃহবন্দী অবস্থায় ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ ও বি.এল পাস করেন। সে বছর গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে শুরু করেন সক্রিয় রাজনীতি চর্চা। ১৯৪১ সালে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পান ৪৫-এর শেষ দিকে। বন্দী থাকাকালীন বিনোদ বিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ৪৬-এ মুক্তি পেয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ – এই তিন পর্বে যত অন্যায়, অপশাসন ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটেছে সবটাতেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদে সোচ্চার, লড়াকু সৈনিক। যেকোনো শুভ শক্তির উদ্বোধনে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত। কর্মকৃতীর স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক সহ রাষ্ট্রীয় নানা সম্মাননা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা লাভ করেন তিনি। ২০১৩ সালে ১০৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রবীণ এই বিপ্লবী।