লোকমাতা রাণী রাসমণি ছিলেন নানা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী। আর তাঁর সম্পর্কে যারা জানেন না সেভাবে, তারা বাংলা সিরিয়ালের দৌলতে বিষয়টি আত্মস্থ করতে পারেন। ইতিমধ্যেই মথুর নামটির সাথে তাদের পরিচিতি ঘটে গেছে। রানীর জামাতা মথুরা মোহন বিশ্বাস নাস্তিক হলেও শুধু রানী মায়ের ইচ্ছে পূরণে দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের আদলেই এক মন্দির নির্মাণ করেন। আর এর পিছনেও ঘটনাবহুল ইতিহাস আছে, সেটাই জানাবো আজ।
যাই হোক, রাসমণি বরাবরই ছিলেন ঈশ্বরের প্রতি আস্থাশীল, ভক্তিশীল। আর এহেন রানী মা বারাণসীতে অন্নপূর্ণা মন্দিরে যাওয়ার জন্য মনস্থ করেন। সেই মতোই তার জামাতা মথুরা মোহন বিশ্বাসের তদারকিতে ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়। কিন্তু পথিমধ্যেই সে যাত্রা ভঙ্গ হয়। কারণ গঙ্গায় বজরা যাত্রাকালে দক্ষিণেশ্বরের কাছে তিনি ভবতারিনীর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যাত্রাভঙ্গ করেন এবং সেখানেই ভবতারিণী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। অব্রাহ্মণের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিস্তর গোল বাধে, কিন্তু ওই দৈব মাহাত্য - মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ সুষ্ঠভাবেই সম্পন্ন হয় তাও ব্রাহ্মণসমাজের চরম প্রতিকুলতা সত্বেও।
কিন্তু অন্নপূর্ণা দর্শন তার অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তাঁর অসম্পূর্ণ যাত্রার শরিক ছিলেন প্রিয় জামাতা মথুরমোহন বিশ্বাস। যদিও নিজে তিনি ছিলেন নাস্তিক - কিন্তু অন্যের বিশ্বাসকে আঘাত করতেন না। তাই রানীমায়ের অপূর্ণ ইচ্ছের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনেই তিনি গঙ্গাতীরে অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। ব্যারাকপুরের সামান্য দক্ষিণে টিটাগড়ের রাণি রাসমণি ঘাটের কাছে গড়ে তোলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে নবরত্নবিশিষ্ট শিবশক্তি অম্নপূর্ণা মন্দির। এই মন্দিরের আরাধ্যা অষ্টধাতুর অন্নপূর্ণা। মথুরবাবু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার সিবিস লিয়ার্ডের এস.এস.টি র জমি থেকে মন্দিরের জমিটি কেনেন। অবশ্য নিজে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী, রাণি রাসমণির কনিষ্ঠাকন্যা জগদম্বা দেবী মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণ করেন। যদিও এই মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়েও সমস্যায় পড়েন জগদম্বা দেবী। কারণ মন্দিরের মাথায় আছে সিংহ মূর্তি, যা নিয়ে কোম্পানি আইনি জটিলতা তৈরী করে। কিন্তু তাতেও জয়ী হন জগদম্বা দেবী। কারণ আদালতের মতে সিংহ বিক্রমের প্রতীক, তাই যে কেউই তা গ্রহণ করতে পারে। তাই আর কোনো বাধা পায় নি।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় কুড়ি বছর পরে ১২ই এপ্রিল, ১৮৭৫ সালে ( ৩০ শে চৈত্র ) রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই মন্দির উদ্বোধন করে, মায়ের মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলেই একই রূপকারের হাতের একই গঠনশৈলীর। এখানেও আছে একই ধরণের নাট মন্দির। অনুরূপ শিবমন্দিরও আছে- কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের মত বারোটি নয়, সংখ্যায় ছ'টি। এর পিছনেও রয়েছে স্বপ্নাদেশ, আর সেটি পান রানী রাসমণির ছোট কন্যা জগদম্বা দেবী, যেন তিনি তার মায়ের ঐতিহ্য ছাপিয়ে না যান। তাই এই ৬টি শিবমন্দির।
আজও মন্দিরটি স্বমহিমায় স্মৃতিচারণ করে চলেছে সেই ইতিহাসের। সকালে মঙ্গলারতি হয় ছোলা, মিশ্রী, মাখনের ভোগ সহযোগে। এখানে দৈনিক আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। আর নৈশ ভোজে থাকে লুচি, সুজি, বোঁদে, দরবেশ। প্রতি মাসে শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে মায়ের বিশেষ পুজো হয়। কলকাতার উপকন্ঠে টিটাগড়-ব্যারারাকপুরে গঙ্গার পূর্বপাড়ে আজ ও দাঁড়িয়ে ছোট্ট দক্ষিনেশ্বর।