কোচ রাজাদের রাজবাড়ী হলো এই কোচবিহার রাজবাড়ী। এই রাজবংশের নাম থেকেই শহরের নামকরণ হয়েছে। তাদের এলাকা আসামের কিছু অংশ, ভুটান সীমানা এবং বাংলার কিছু অংশ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই রাজবাড়ি কেমন দেখতে তা অনেকেই জানেন, কিন্তু এই কোচবিহার রাজ্য গড়ে ওঠার পিছনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, যাতে এই রাজবংশের বিশেষ ভূমিকা আছে। কোচবিহারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সাথে এই রাজবাড়ির ঐতিহ্য ও এই প্রজন্মের পরিবারের সদস্যদের কথাও আজ বলবো। এই রাজবংশের ইতিহাস একটু জানা যাক।
বাংলায় ও কামরূপে পালদের পতনের পর বাংলা ও কামরূপ (আসাম)খন্ড খন্ড হয়ে যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট হয়। সেই সময় একাধিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে শাসন চালাতে থাকে। এমনি ১২ ভূঁইয়া নামক এক জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন হাজো। তাঁর দুই মেয়ে ছিল হীরা ও জীরা। এই গোষ্ঠীর পাশেই শাসন করতো 'মেচ' জনগোষ্ঠী - যার নেতা ছিল হাডিয়া মন্ডল বা হরিদাস মন্ডল। ১২ ভূঁইয়ার নেতা হাজো মেচদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তার দুই মেয়ের সাথে হাড়িয়া মন্ডলের বিয়ে দেন, এই হীরার ছেলে ছিল বিশু বা বিশ্ব সিংহ। অন্য ভাইদের থেকে সে ছিল বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। এই বিশু ছোট ছোট সমস্ত গোষ্ঠী জয় করে একত্রিত করে নাম দেন 'কোচ রাজ্য ' ।
এই বিশ্ব সিংহ ‘রাজা’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলে শুরু হলো কোচ রাজবংশের পথ চলা। তিনি ‘কামতেশ্বর’ উপাধি ধারণ করে ১৫০০ সাল থেকে শাসনের সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর রাজা হন তার ৩ পুত্রের মধ্যেই অন্যতম নরনারায়ণ। এর পর অখণ্ড কোচ সাম্রাজ্য ৩ ভাগে ভাগ হয় এবং কোচবিহার এর রাজা হন নরনারায়নের ছেলে লক্ষ্মী নারায়ণ।
নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেই দিয়ে চলা এই কোচ রাজ্যের নতুন বিপদ হয়ে আসে ভুটান। ভুটিয়ার প্রভাব এতটাই বেড়েছিল যে ভুটানের সেনা দপ্তরের একটি অফিস স্থায়ীভাবে কোচবিহারে স্থাপন করা হয়। ইতিমধ্যেই ধীরেন্দ্রনারায়ণকে ভুটান বন্দী করলে তাঁর পুত্র ধরেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে বসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ভুটিয়াদের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে খানিক চিন্তিত হয়ে ৫ই এপ্রিল ১৭৭৩-এ তরুণ মহারাজা ধরেন্দ্রনারায়নের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এরপরে ভুটান এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে ২৫শে এপ্রিল ১৭৭৪ সালে একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয়, যার ফলস্বরূপ ধীরেন্দ্রনারায়ণকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি ১৭৭৫ সালে মারা গেলে ধরেন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একমাত্র উত্তরাধিকারী হরেন্দ্রনারায়ণকে রেখে ১৭৮০ সালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে নরেন্দ্রনারায়ণ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পরবর্তী কালে নান ঘটনাচক্রের মধ্যে দিয়ে এই রাজপরিবার পায় সবথেকে সফল রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে । মাত্র এক বছর বয়সে তাঁর পিতার সিংহাসনে আসীন হন। তাঁর সময়ে প্রশাসনের দায়িত্ব রাজ্যপাল কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনারের হাতে দেওয়া হয়। সেই শাসনকাল থেকেই কোচবিহারের প্রশাসন আধুনিক পর্যায়ে প্রবেশ করে। প্রথম কমিশনার ছিলেন কর্নেল জেচহটন ।
কমিশনারদের দ্বারা প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণের পরে মহারাজা দ্বারা খানিক ব্রিটেনের অনুকরণেই শাসন অব্যাহত ছিল। নৃপেন্দ্রনারায়ণের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। ইংরেজদের সহায়তায় 'ভিক্টর জুবিলী প্যালেস’ তৈরী করেন, বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে - যা আজ ‘কোচবিহার রাজবাড়ি’ নামেই খ্যাত। ১৮৮৭ সালে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের ১৯১১ সালে মৃত্যুর পর স্বল্প সময়ের জন্য পুত্র রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ, তাঁর ভাই জিতেন্দ্রনারায়ণ ক্ষমতায় আসেন। ১৯১২ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর নাবালক পুত্র জগদীপেন্দ্রনারায়ণের স্থলে স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন কোচবিহারের শেষ মহারাজা।
১৯৪৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর কোচবিহারকে ভারত সরকারের হস্তান্তরিত করা হয়। ভারতের সংবিধানের ২৯০ এর ধারানুযায়ী ১৯৫০ সালের ১ লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের সাথে একীভূত করা হয়। সেই থেকে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গ জেলা হিসাবে শাসিত হচ্ছে। এতো গেলো কোচদের ইতিহাস। আর তাদেরই এই বিখ্যাত রাজবাড়ি। যা আজ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে।
ইউরোপীয় স্থাপত্যের মিশেলে বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে ১৮৮৭ সালে নৃপেন্দ্রনারায়ণের হাত ধরে নির্মিত হয়েছিল এই প্যালেস। প্রায় ৫২০০০ বর্গফুট জুড়ে আছে এই রাজবাড়ী। ইতিহাস বিজড়িত দ্বিতল বিশিষ্ট রাজবাড়িটি লম্বায় ৩৯৫ফুট, চওড়ায় ২৯৬ ফুট, মাটি থেকে প্রায় ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি উপরে। প্রাসাদের মাঝে আছে গাড়ি বারান্দা বা প্রবেশপথ, যা দিয়ে সোজা দরবার হলে প্রবেশ করা যায়। বিশ্বের প্রিয় সব জায়গা থেকে তৎকালীন আধুনিক উন্নত মানের আসবাব এনে প্রাসাদকে অলংকৃত করা হতো।
করিন্থিয়ান পিলারের উপর যে ৪টি জানলা আছে তাতে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরনে মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হতো। প্রাসাদের শীর্ষে আছে গম্বুজ আর তার নীচে আছে দ্বাদশ কোন বিশিষ্ট আকর্ষণীয় বারান্দা। ভিতরে আছে ৫০টির বেশি ঘর - যার মধ্যে আছে লেডিস গ্যালারি, ড্রয়িং রুম, বিলিয়ার্ড হল, ড্রেসিং রুম আরো কত কি! যা আজও ঐতিহাসিক স্মৃতিকে তরতাজা করে তোলে। রাজবাড়ির করিডোর থেকে দেখা যায় টেনিস কোর্ট, টেবিল টেনিস খেলার জায়গা। এ ছাড়াও আছে মদনমোহন মন্দির, সামনে বৈরাগী মন্দির। জয়পুরের রাজমাতা ছিলেন এই কোচ বিহার রাজবাড়ির রাজকন্যা। গায়ত্রী দেবীর ভাগ্নি উত্তরা দেবী এবং ছোট বোন মেনকা দেবী এখনো বেঁচে আছেন, যদিও তাঁরা কেউই আর সেখানে যান না, তবে গায়েত্রী দেবী নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করে রাজবাড়ির যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পরিবারের কিছু সদস্য জীবিত থাকলেও রাজমাতা গায়েত্রী দেবী মৃত্যুর পর তা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে আছে। এখন অবশ্য বংশধররা নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন, কিছু আছেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার পাঙ্গ রাজবাড়িতে। কিন্তু জীবিত সদস্যরা তাঁদের রাজপরিবারের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়া এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের আশায় আছেন।
প্যালেস এখন পর্যটকস্থল। সকাল ১০ থেকে বিকেল ৪ পর্যন্ত খোলা, পুরো রাজবাড়ি ২৫ টাকা টিকিটের বিনিময়ে ভালো করে ঘুরে দেখতে লাগবে ঘন্টা তিনেক। তাই সময় করে লন্ডনে নয়, বঙ্গেই বাকিংহামের রেপ্লিকা এই হেরিটেজ বিল্ডিং দেখে ইতিহাসের সাক্ষী হতেই পারেন।