বলতেন অন্যেরা তাঁকে পাগল বললেও, সেই পাগলামিতেই সৃষ্টি হয় শিল্পের।এইভাবেই পিঠে ক্যানভাস, স্যাক ব্যাগে সরঞ্জাম নিয়ে উদভ্রান্তের মতোন দিকবিদিক ঘুরেছেন তিনি। কখনও মাঠে, প্রান্তরে; আবার কখনও পাহাড়ে, জঙ্গলে, দূরের শহরে। কী খুঁজছিলেন তিনি?
নিজের কান কেটে কাগজে মুড়ে উপহার দেন গনিকাকে। সেই কানে ব্যাণ্ডেজ বেধে আঁকেন সেল্ফ পোর্ট্রেট। নিজের পছন্দের ছবির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলেন তাঁর অন্যতম অমর সৃষ্টিকে। অন্য এক শিল্পীকে বলেছিলেন এই আঁকা ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্য স্টারি নাইটস। এক তারাভরা রাতের নিসর্গ চিত্র।
আর তিনি? আর কি বলার অপেক্ষা রাখে, তিনি আর অন্য কেউ নন - ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। শিল্পী মননের সঙ্গে মানবিক যন্ত্রণার মিশেলে গড়ে ওঠা এক অতিমানব চিত্রকর। ছোট ভাইয়ের পয়সায় ছবি আঁকার উপকরণ কিনতেন। মারা যাওয়ার আগে মাত্র একটি ছবি বিক্রি হয়েছিল। কিনেছিলেন এক বন্ধু চিত্রকর ।
বিধবা মাসতুতো বোনের প্রেমে পাগল হয়ে আগুনের উপর হাত রেখে দিয়েছিলেন, যতক্ষণ না সে হ্যাঁ বলে। একাকিত্বের সঙ্গী এই নিভৃতচারী শিল্পী চিত্রশিল্পের ভাণ্ডারকে করে গিয়েছেন সমৃদ্ধ। কারও আত্মপ্রতিকৃতি এতটা নীরব যন্ত্রণার ভাষায় লেখা থাকতে পারে! কেউ যন্ত্রণাকে এতটা রঙিন করে তুলতে পারেন!
এত বিস্ময়ের স্মারক সমান এক দুঃখ বিলাসী সূর্যমুখীর জন্মদাতা, সেই শিল্পী। আজও একটা ছেলে যখন ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এই চারপাশের মাঝেও পাহাড়ের কোনও এক বাঁকে মাউথ অর্গ্যান বাজানো কোনও মেয়ের ছবি আঁকে, সে গঘ হয়ে ওঠে। ছেলেটিও স্বতন্ত্র। কিন্তু গঘের আত্মা যেনো তাকে ভর করে। আজও এত অস্থিরতার মাঝেও গ্রামের গলি পরে কোনও ফোঁকলা অপু হয়ত তার বাবার অপেক্ষায়। তিনি ভীন রাজ্যে কর্মরত। তাঁর জীবনের শেষ তিনশো কিলোমিটার হাঁটছিলেন। পুরোটা পেরে ওঠেননি। ইনিও গঘ হতে পারেন।
সাতাশ বছরে তুলি হাতে নেওয়া। কী ভাবছেন? হ্যাঁ, এখনও দেরি হয়নি। এখনও সবাই মিলে এই পৃথিবীকে সত্যিই আগামী শিশুর বাসযোগ্য করে তুলতে পারবেন। এইভাবে স্বপ্নে আসেন ভ্যান গঘ। অন্যান্য শিল্পীদের তুলনায় তাই কিছুটা বেশি বয়সেই শিল্পের জগতে তাঁর পা রাখা। কিন্তু তাতে কল্পনার চোখ আসতে কোনও ভাবেই বিলম্ব হয়নি। দুই হাজারেরও বেশি ড্রইং, পেইন্টিং, জলরঙে আঁকা ছবি ও স্কেচ জীবিত রয়েছে।
তাঁর ছবির নান্দনিকতা এখনও যেমন আলোচিত হয়, তেমনই ছবিগুলোর বিক্রি মূল্য শুনলে শিল্পীর আত্মা আবার হয়তো কান কেটে ফেলতে পারেন। প্যারিসের প্রদর্শনীতে প্রথমবার উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে তাঁর ছবি। ক্লদ মনে পর্যন্ত বলেছেন সেই প্রদর্শনীর সেরা তুলি ভিনসেন্ট। ওই নামেই শেষ করতেন ছবির কাজ। এরকম একটা পাওয়া উপেক্ষা করে কেনো তবে অকালে চলে যাওয়া? মতামতের বিভিন্নতা এখানেও আছে।
যিনি প্রকৃতিকে এত সুন্দর করে সাজালেন, সেই প্রকৃতিই তাঁকে কিছু ফিরিয়ে দিল না! গত বছরেই At Eternity’s Gate সিনেমার অভিনেতা উইলিয়াম ডেফো চোখে পরেছিলেন শিল্পী ভিনসেন্টের চশমা। অসাধারণ অভিনয়ে ডেফোর ভ্যান গঘ বড় জীবন্ত। সম্প্রতি শ্রীজাতও লিখেছেন এক উপন্যাস ‘তারা ভরা আকাশের নীচে’, যা নিয়ে স্বপ্নসন্ধানীর নাটক তারায় তারায়-এ ভ্যান গঘের চরিত্রে অভিনয় করছেন বেলা বোসের প্রেমিক।
তারারা ফিরে আসেন এভাবেই। চেয়েছিলেন সবকিছুর পরও উঠে দাঁড়াতে। পেন্সিল টা হাতে নিয়ে ভেবেছিলেন হেঁটে আসবেন কোনও নির্জন পাহাড়ের গলিতে। আসলে জীবনটাই অস্থিরতার উপহার। সারাটা জীবনে মান পায়নি তাঁর নাম। জীবনের ক্যানভাসে অভাব ছিল ভালোবাসার গাঢ় রঙের। তাই শিল্পীর শ্রান্ত মন রাখার জন্য ভাই ছাড়া আর কারও কোল পাননি তিনি। মাঝে মাঝে আহত প্রেম চিৎকার করে উঠলে, করে ফেলেছেন অশালীন আচরণ, জুটেছে অপমানও।
আজ তাঁর ছবি Portrait of Dr. Gachet গৌরবান্বিত করছে পৃথিবীর সব থেকে দামী ছবি গুলির তালিকা। অথচ লোকটা ভাইকে জানিয়েছিলেন এখন তাঁর দিন কাটছে উপোস করে, পয়সা নেই খাবার কেনার। অনিয়ন্ত্রিত একরোখা যাপন, নেশা, মাঝেমাঝে মানসিক অস্থিরতা ভুগিয়েছে তাঁকে আজীবন।
পাগলের মত এঁকে যাওয়া একের পর এক ছবি..ছবির সন্ধান। মাত্র কয়েকটা বছরের চুড়ান্ত সৃষ্টিশীলতা…তো পরক্ষণেই মানসিকভাবে বিকৃত! সেরা ছবিগুলির প্রায় সবকটিই ভিনসেন্ট খুঁজে পেয়েছেন জীবনের শেষ তিনটি বাঁকে। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেও রং উগড়েছেন ক্যানভাসে। এক আবেগঘন মিথে লেখা তাঁর জীবন।
আর্লেস এর সেই হলুদ বাড়ি গুড়ো করে দিয়েছে বিশ্বযুদ্ধ । তবু সেই জায়গাটা দেখতে প্রতি বছর পর্যটকের ঢল নামে। সেখানেই তো প্রথমবার চোখ খুলে দেখেছিলেন এই পৃথিবীকে। আজকের দিনে। সার্ধ শতবর্ষ হতে আর মাত্র তিনপা দূরে চিত্রকর। জিও বাংলা এই মহান শিল্পীকে উপহার দেয় অনেক অনেক তারাভরা আকাশের রাত।