গুরু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন সুকুমার সেন। ছিলেন গুরুর মতোই জ্ঞানতাপস। বর্ধমানের ছেলে সুকুমার গুরু হিসেবে সুনীতিকুমারকে পেয়েছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে। অল্পদিনেই স্নেহধন্য হয়েছিলেন। পরে হয়েছিলেন সহকর্মী, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সূত্রে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সুকুমার সুযোগ্য ছাত্র ছিলেন; কিন্তু সুযোগসন্ধানী একেবারেই ছিলেন না। ছিলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মানুষ। একটা ঘটনার কথা বলি, তাহলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এর একটি পাঠকক্ষে সুনীতিকুমার ভাষাতত্ত্ব পড়াচ্ছেন। পড়াচ্ছেন, সংস্কৃত শব্দের 'উচ্চারণ' নিয়ে। পড়ানোর সময় ছাত্রদের মনে কোন প্রশ্ন জাগলে, সেই প্রশ্ন সুনীতিকুমারকে নির্দ্বিধায় করা যেত, এবং তিনিও প্রসন্নচিত্তে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আসলে, সেই সব প্রশ্ন শোনার এবং উত্তর দেবার মতো পণ্ডিত আর কেউ তেমন ছিলেনও না। তবে, সবার মনে প্রশ্ন তো আর জাগত না, জাগত সুকুমারের মতো বিশিষ্ট কিছু ছাত্রের মনে।
সেদিন যেমন 'উচ্চারণ' বিষয়ে জাগল। প্রশ্ন করতেই সুনীতিকুমার বললেন যে, তাঁর কাছে এ-বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক মেইয়ের দেওয়া নোট আছে, সুকুমার তাঁর বাড়িতে গিয়ে যেন লিখে নেন। শিক্ষক বাড়িতে ডাকছেন, এ তো আনন্দের কথা। এতে শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের আত্মীয়তা বাড়ে। এই আমন্ত্রণ যে-কোন ছাত্রের পক্ষেই সম্মানের, গর্বের এবং অহংকারের। এত ছাত্রের মধ্যে 'বিশেষ' এবং 'স্নেহধন্য' হওয়ার সুযোগ। কিন্তু, সচেতনভাবেই সুকুমার সে-সুযোগ নিলেন না।
সরাসরি অথচ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, 'স্যার, আমি অবশ্য কাছেই থাকি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে পরের ক্লাসের দিনে এনে দেন তো ভালো হয়।' সুনীতিকুমার এক মুহূর্তেই প্রিয় ছাত্রকে অনুধাবন করে ফেললেন। বুঝলেন, ইনি আর পাঁচ জনের মতো বিদ্যায়, শিক্ষায় এবং স্বভাবে গড়পড়তা নন। তাঁর গম্ভীর মুখেও ঠোঁটের কোনে সন্তুষ্টির হাসি ফুটল। এবং, পরের ক্লাসে নোটটি আনতে ভুললেন না।
স্নেহধন্য ছাত্র হয়েও সুকুমার ছিলেন বিদ্যাক্ষেত্রে নির্ভীক। সাধারণেরা সাধারণত প্রিয় শিক্ষকের দোষ ঢাকতে চাইতেন, এখনও চান। কারণ, তাঁদের মধ্যে প্রিয় শিক্ষকের বিরাগভাজন হয়ে ওঠার ভয় কাজ করে। সুকুমারের সে দুর্ভাবনার বালাই ছিল না। তিনি ভাষাতত্ত্ব'র পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী হয়েও প্রশ্নপত্রকর্তা সুনীতিকুমারের প্রশ্নের ভুল ধরেছিলেন এবং পরীক্ষার খাতায় সেটা স্পষ্ট ভাষায় লিখেও এসেছিলেন। সুনীতিকুমার ছিলেন সৎ-শিক্ষক এবং প্রকৃত পণ্ডিত।
তিনি তাই তাতে একটুও রাগ করেননি। বরং ছাত্রের নির্ভিকতা, অধ্যবসায় এবং সততায় অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছিলেন। নিজের ভুল স্বীকার করে ছাত্রের পাণ্ডিত্যে সারাজীবন গর্ব করেছেন। সুকুমার তোয়াজ করে গুরুর স্নেহধন্য হননি, হয়েছিলেন নিজের গুণপনা ও পাণ্ডিত্যের জন্য।
সুনীতিকুমার সুকুমারকে কতটা স্নেহ করতেন, তারও প্রেক্ষাপটে রয়েছে গল্প। সুকুমার তখন সুনীতিকুমারের সহকর্মী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একবার স্বল্পকালীন বিদেশ ভ্রমণে যাবার আগে যে যে বিষয়গুলো সুনীতিকুমার পড়াতেন, সেই সেই বিষয়ের ক্লাস নেবার ভার তিনি দিয়ে গেলেন সুকুমারকে। পরিবর্ত হিসেবে সুকুমারকেই তিনি যোগ্যতম বলে মনে করেছিলেন।
সুনীতিকুমার ক্লাস নিতেন ইংরেজিতে। তা অনেক ছাত্রেরই মাথার ওপর দিয়ে যেত। তাই সেই সব ছাত্র সুকুমারকে পেয়ে অনুরোধ করলেন বাংলায় ক্লাস নিতে। গুরুর প্রথা ভাঙার অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ছাত্রদের সুবিধের কথা মাথায় রেখে সুকুমার বাংলাতেই ক্লাস নিতে শুরু করলেন। নির্দিষ্ট সময়ে সুনীতিকুমার বিদেশ থেকে ফিরলেন। নিজের ক্লাসেও যোগ দিলেন। বেশ কয়েকদিন বাংলায় লেকচার শোনার সুবিধে পাওয়া ছাত্রেরা তাঁকে সুকুমারের উদাহরণ দিয়ে অনুরোধ করলেন বাংলায় পড়ানোর জন্য।
কিন্তু, সুনীতিকুমার স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন যে, সুকুমার বাংলায় পড়িয়েছেন বেশ করেছেন, কিন্তু তিনি পড়াবেন ইংরেজিতেই! আর পাঁচ-জন শিক্ষক-অধ্যাপক নিজের তৈরি করা প্রথা কেউ ভাঙলেই রাগ বা অভিমান করতেন; মনে করতেন সুকুমার তাঁর ওপর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন; কিন্তু, সুনীতিকুমারের সে-সব ছিল না। তিনি নিজের ঐতিহ্য নিজে বজায় রেখেও স্নেহের সুকুমারের উদ্দেশ্যে 'বেশ করেছেন' বলে শুধু প্রশ্রয়ই দিলেন না, তাঁর ছাত্রবন্ধু হওয়ার প্রবণতাকেও সম্মান জানালেন।
গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সুনীতিকুমারের পাণ্ডিত্য, সহৃদয়তা, বিশ্ববিদ্যার পাঠস্পৃহা যেমন সুকুমার অলংকার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি গ্রহণ করেছিলেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তাঁর 'আপনি' সম্বোধনের ঐতিহ্যও। এবং, গুরুর মতোই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন প্রাচ্যের জ্ঞানভান্ডারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং উত্তরাধিকারের বীজ। বজায় রেখেছিলেন গুরুশিষ্য পরম্পরা।