“ একতলার বোর্ডিং বাড়ি। তার ছাদে সেই বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করত। একদিন মহা হইচই বাঁধল খেলার মাঝে। কি, না তাদের মধ্যেই তাতা নামে একটি ছেলে সে এতই দুষ্টু যে কাঠির আগায় কাগের শুকনো ইয়ে- যা কিনা মুখে আনাও বারন সেই ফুটিয়ে সবাইকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অনেক কষ্টে তাঁকে ধরে বেঁধে শান্ত করা হল।”
সেদিনের সেই দুষ্টু ছেলে তাতা পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহীরুহ শ্রী সুকুমার রায়।
লীলা মজুমদার তাঁর বড় দা’র কথা লিখতে গিয়ে এই গল্প বলেছেন।
সুকুমার রায়ের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে। জন্ম সূত্রেই রক্তে মিশেছিল বিজ্ঞান আর রসের টান।
মাতামহী কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ছিলেন সে যুগের ভারত বিখ্যাত ডাক্তার। শুধু ভারতের নয়, বিলেতের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাগনেয় ‘কুন্তলীন’ খ্যাত হেমেন্দ্র বসু সুকুমারের পিসেমশাই। রস আর রসায়ন এভাবে মিশেছিল সুকুমারের নিজস্ব চর্চায়।
শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন দুই দিকই প্রচলিত প্রথার বাইরে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দুটি বিষয়ে অনার্স নিয়ে পাশ করেছিলেন। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করতে। প্রিন্টিং টেকনোলজির ব্লক নির্মাণ শিখতে। চেনা বাঙালির প্রচলিত ছকে বাঁধা জীবন তাঁর কোনও দিন ছিল না। ম্যানচেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজি’তে ফটোগ্রাফী এবং ব্লক নির্মাণে প্রথম হয়েছিলেন। রয়্যাল ফটোগ্রাফি সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সদস্য তিনি। বিজ্ঞানের কথা, বিজ্ঞানের গল্প লিখে গিয়েছেন শিশুদের বোঝার মতো ভাষায়। আসলে তিনি সারাজীবন সহজ ভাষায় গভীর কথা বলে গিয়েছেন। বাংলা ভাষায় প্রথম ননসেন্স ছড়া লেখেন সুকুমার রায়।
১৯১৩ সালে বিলেত থেকে ফিরেই উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। একেবারে নতুন এক অভিনবত্ব দেখা গেল লেখায়। বাংলায় ‘ননসেন্স ভার্স’।
বড় কথা, বড়দের বিষয় তাঁর লেখায় উঠে এসেছিল ছেলেমানুষী ভাষায়।
দাদা গো! দেখেছি ভেবে অনেক দূর-
এই দুনিয়ায় সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
সস্তা ভাল দামীও ভাল...
লাইনগুলোর মর্মে প্রবেশ করলে শব্দের অন্তস্থলের নির্জাসটুকু অনুভব করা যায়।
মানডে ক্লাবের একদা সদস্য হিরন্ময় সান্যালের কথায়, তিনি যেখানেই দাঁড়াতেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতেন মানুষকে। সব সময় যে মজার কথা বলতেন এমন নয়, অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন।
শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প'ড়ে,
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার-
একুশ টাকা দণ্ড তার।।
ছড়ার ছত্রে ছত্রে ব্যঙ্গ। ব্যঙ্গের তিরটা শাসকের দিকে। মজার মোড়কে দ্ব্যর্থ ব্যঞ্জক ভাষায় শাসনব্যবস্থার অসঙ্গতি নিয়ে সরাসরি কটাক্ষ।
লীলা মজুমদার বড়দা (সুকুমার) সম্বন্ধে লিখেছেন,- “লম্বা দোহারা মানুষটি। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসত। কিন্তু গম্ভীর হলে এমন গম্ভীর হত যে কাছে যেতে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিল যেমন আমুদে তেমনি রাশভারী। অন্যায় সে কখনও সইত না।”
শুধুমাত্র ছড়ার ক্ষেত্রে না, তাঁর লেখা গল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ছোটদের জন্য লেখা গল্পগুলো নিছক গল্প হয়েই শেষ হয়ে যায়না, সরল আঙ্গিকে, সহজ কথায় জীবন বোধের শিক্ষা দেয়।
তবে অনেকের মতে খুব ভেবেচিন্তে দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ভাষায় জটিল কোনও বিষয় তাঁর লেখায়, সাহিত্যকর্মে বলতে চাননি সুকুমার। কিন্তু সুকুমারের লেখা ছোটদের হয়েও বড়দের। সব বয়সের মানুষকে স্পর্শ করে।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, যাঁর হৃদয় পুষ্পের মত শুচি ও সুন্দর নয়, তাঁর পক্ষে এসব গল্প রচনা করা সম্ভব হত না। মনে হয় তিনি হাসাবার জন্য এসব লিখে যাননি।...