বলিউডের ‘দাদি’ জোহরা মমতাজ সেহগল

বয়স যখন মাত্র এক তখনই হারিয়েছিলেন দৃষ্টি। গ্লুকোমা আক্রান্ত হয়ে একটি চোখ অন্ধ। দুধের শিশুর এমন দূর্ভাগ্য মেনে নিতে পারেনি পরিবার। সর্বস্য বাজি রেখে তাঁরা মেয়েকে নিয়ে যান ইংল্যান্ডে চিকিৎসা করাতে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ফিরে আসে চোখের আলো। লড়াইটা শুরু হয়েছিল তখনই, চলেছিল আজীবন। যোদ্ধার নাম জোহরা সেহগল।

বলিউড তাঁকে চেনে ‘দাদি’ হিসেবে। অশক্ত, বৃদ্ধ শরীর। কিন্তু অভিনয়ের দ্যুতি নজর কেড়ে নেয়। অভিব্যক্তি দিয়েই পর্দা জয়। সব চোখ তাঁর দিকে।

পুরো নাম সাহাবজাদি জোহরা মমতাজ সেহগল। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। এক্কেবারে ছোটবেলায় মাকে হারান। মা মেয়ের জন্য রেখেছিলেন নিজের স্বপ্নগুলো। সেই স্বপ্নকে ব্যর্থ হতে দেননি জোহরা। মা চাইতেন মেয়ে পড়াশোনা করুক। বিদুষী হোক। কুইন মেরি কলেজ উচ্চশিক্ষা নিক।কিন্তু কলেজে ভর্তির আগেই জোহরা বেরিয়ে পড়েন পৃথিবী প্রদক্ষিণে। চার চাকার গাড়িতে জোহরা আর তাঁর কাকা। সেই গাড়ি ভারত হয়ে ঘুরে বেড়ায় পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে। নানা জাতি, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। এই অভ্যাস তাঁর আজীবন ছিল।     

এক সময় ছিলেন বিদুষী নৃত্যশিল্পী। বলগাহীন হরিণীর মতো জীবন। মুক্ত ভাবনার মানুষ। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি নৃত্যশিল্পী। থিয়েটার আর্টিস্ট। উদয়শঙ্করের গ্রূপে সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সেখানেই তাঁর কেরিয়ার শুরু। জন্ম উত্তরপ্রদেশের শাহারানপুরে। ১৯১২-র ২৭ এপ্রিল। দুরন্ত অভিনেত্রী প্রথম জীবনে ছিলেন তুখোড় নৃত্যশিল্পী। কিন্তু ছোটবেলায় দেখে এতটুকু বোঝার উপায় ছিল না আগামীর নক্ষত্রকে। একেবারে টমবয়! পুতুল খেলার চেয়েও গাছে চড়া, পাঁচিল পালানো এসব ছিল খুব প্রিয়।

পড়াশোনা পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানে পড়া শেষ হতেই চলে যান ইউরোপে। জার্মানির এক কলেজে নাচ নিয়েই পড়াশোনা। তিনবছর পর ফিরে এসে যোগ দেন উদয় শঙ্করের দলে। সেটা ১৯৩৫। দলের হয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান, মিশরের মতো দেশে সফর করেছিলেন। খুব ছোটবেলায় দেহরাদুনে একবার উদয় শংকরের প্রোগ্রাম দেখেছিলেন। সেই দেখাই স্থির করে দিয়েছিল জোহরার আগামী। নিজেও বলেন উদয় শংকরকে দেখাই তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

zohra-002

বিয়ে করেন কামেশ্বর সেহগলকে। ভিন্ন ধর্মে বিয়েতে মত ছিল না পরিবারের। তোলপাড় হয়েছিল। সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকার কথা ছিল জহরলাল নেহেরুর। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তিনি তার আগেই গ্রেফতার হন। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ছিলেন পাকিস্তানের বাসিন্দা। ১৯৪৫-এ যুক্ত হন মুম্বইয়ের পৃথ্বী থিয়েটারে। তখন তাঁর ১৪ বছর বয়স। শুরু করেন নাটক অভিনয়। সেই সময় তাঁর মাসিক বেতন ৪০০ টাকা। বাকি ১৪ বছর দল নিয়ে ট্যুর করেছেন দেশের নানা প্রান্তে।

zohra-001

আইপিটিএ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বহু সফল প্রোডাকশনে থেকেছেন। ১৯৪৬-এ ‘ধরতি কা লাল’ ছবি দিয়ে তাঁর ছবির দুনিয়ায় প্রবেশ। চেতন আনন্দের ‘নিচা নগর’ ছবিতে তাঁর অভিনয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ প্রশংসা পেয়েছিল। পাম ডিওর সম্মান পায় সেই ছবি। বলিউডে প্রায় ৬ দশকের অভিনয় জীবন। কাজ করেছেন ব্রিটিশ টেলিভিশনে। হলিউড ছবিতেও দেখা গিয়েছিল জোহরাকে।

অভিনয়ের পাশাপাশি কোরিওগ্রাফি করেছেন ছবিতে। বর্ণময় তাঁর জীবন। বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে বয়ে গিয়েছে। জীবনে কখনও কোনও ছবিতে না বলেননি। চরিত্রের মাপ যাই হোক সবেতেই তিনি রাজি, শুধু কাজটা মনমতো হতে হবে।  

zohra-003 (1)

খুব ভালোবাসতেন কবিতা। অনুষ্ঠানও করতেন দেশ-বিদেশে। আজও তাঁর কবিতাপাঠ মুগ্ধ করে ডিজিটাল দুনিয়ার বাসিন্দাদের। ‘দাদি’ জোহরা সেহগলকে সবাই চেনে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নৃত্যশিল্পী, থিয়েটার অভিনেত্রী জোহরা দেশের মানুষ সেভাবে চিনল কই!

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...