বিমল মিত্র তাঁর লেখা দেখে বলেছিলেন, ‘ তোমার কলমে জোর আছে। নিজের চোখে দেখা চেনা জগৎ নিয়েই লেখো’
এই কথাকে আজীবন মনে রেখেছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য। বাংলা সাহিত্যের দুই বট বৃক্ষ বিমল মিত্র ও রমাপদ চৌধুরীর বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিলেন। প্রবীণ এবং নবীন সকলেরই তিনি কাছের মানুষ। নিজের চেনা, নিজের দেখা শহরটারই দিন যাপনের গল্প তিনি বলতেন নিজের লেখনীতে। রক্ত মাংসের চরিত্র, দোষগুণ, হার জিৎ দিয়েই গড়ে উঠত চরিত্ররা।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘দহন’ সেই উপন্যাসের কাহিনী নিয়েই ছবি করেন প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঝিনুক আর রোমির গল্প। এক পাঠক সুচিত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘গল্পের প্রধান চরিত্র ঝিনুক এত সাহসী হয়েও শেষপর্যন্ত হেরে গেল কেন?’
উত্তরে বলেছিলেন, ঝিনুক হেরে গেল আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন? যদি পেয়ে থাকেন, তবে বলবো, আমি আপনাকে এই কষ্টটাই দিতে চেয়েছিলাম’
ঝিনুকরা আসলে লড়াই করে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষ আর সমাজই তাদের হারিয়ে দেয়। জিততে তারা পারে না।
নিজের দেখা জগৎ আর পাঠকের চেনা দুনিয়া মিলেমিশে যেত। কখনও মনে হত না মেকি।
সুচিত্রার জন্ম ১৯৫০ এর ১০ জানুয়ারি। বিহারের ভাগলপুরে। মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে।
ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী। সুচিত্রার প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল একটি ছড়া। প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। অভিনয় করতেন। নাটক করতেন ‘কাবুলিওয়ালা’ এবং ‘হারানো সুর’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী হিসেবে। গীতা দে তাঁকে বলতেন ‘আমার ছাত্রী’।
পড়াশোনা লেডি ব্রাবোর্ন, যোগমায়া কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালযে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বিষয় বাংলা সাহিত্য। শেষ দিকে রসায়নশাস্ত্র।
একেবারে দুই বিপরীত ধর্মী শাখা। মিশ্র পড়াশোনা লেখালেখিতেও প্রভাব পড়েছে। ১৯৭৯ সালে চাকরি নেন ‘ওজন ও পরিমাপ দপ্তরে’।
কর্ম জীবন এবং সাহিত্য জীবন দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য আসার পরেই বদলে যাননি। মানুষের সঙ্গে মিশতেন একেবারে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর মতো।
থাকতেন ঢাকুরিয়ায়। রেল লাইন পেরিয়ে তাঁর বাড়ি। কান পাতলে নিঝুম রাতে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। পরিচিত- অপরিচিত যেই আসুক দরজা খুলতেন নিজের হাতে। ঠিক যেন তাঁর উপন্যাসের নায়িকাদের মতো। পরিপাটি মানুষ। রান্না করতে ভালো বাসতেন। আবার খুন্তি হাতে ওস্তাদ রাঁধুনি। মোগলাই, চাইনিজ কী বাঙালি রান্না সবেতেই স্বচ্ছন্দ। রাজনৈতিক বোধে, বিশ্লেষনে মেধার ছাপ স্পষ্ট।
সব সময়ে লেখার জন্য স্বেচ্ছা-অবসর নেন ২০০৩ সালে।
রূপকথার জন্ম’ নামে তার একটি গল্প পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুগ্ধ তাঁকে দেশ পত্রিকায় লিখতে আমন্ত্রণ জানান।
প্রথম গল্প ‘বাদামী জড়ুল’। প্রথম উপন্যাস ‘আমি রাইকিশোরী’। লিখেছেন শিশু ও কিশোর সাহিত্য। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ২৪টি এবং ছোট গল্পের সংখ্যা অসংখ্য। তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দমকা হাওয়া’।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক, ভাঙন, টালমাটাল জীবনের ঘূর্ণি তাঁর লেখায় মেয়েরা কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠত। শুধুমাত্র এই কারণেই তাঁকে ‘নারীবাদী লেখিকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলে বিষয়টির সঙ্গে খুবই বিরোধ ছিল তাঁর।
তাঁর লেখায় নারীরা আত্ম পরিচয়ের সন্ধান করত। রোজকার জীবনের চেনা চরিত্র আর তাদের লড়াই, আশা আকাঙ্খা, বিপর্যয় সবই একক থেকে মিশত বৃহত্তর ক্ষেত্রে। গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা অনেকেই তাঁর আশেপাশের মানুষ। নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা জারিত হইয়ে উঠে আসত কালি-কলমে।
চেয়েছিলেন লিখতে লিখতে থেমে যেতে। জীবন তাঁকে সেই কিনারেই নিয়ে গেল। ২০১৫ সালের ১২ মে।