আমার বছর দশেক বয়স হওয়ার আগে অব্দি আমার গাঁয়ে টিভি ঢোকেনি। গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিল ভিডিও হল, সিনেমা হল। সেই বয়সে বা তার আগে সেখানে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রশ্নই ছিল না। উত্তমকুমারের সঙ্গে তবুও দেখা হয়েছিল, আলাপ হয়েছিল। এবং সেটা আমার গ্রামেই। আমি মাটিতে আর উনি পঁয়ত্রিশ মিমির রুপোলি পর্দায়। আমি স্বপ্নের রাস্তায়, আর উনি স্বপ্নের জগতে--জীবন-বাস্তবতার স্তর ছাড়িয়ে বিরাট-মোহময়-মহানায়ক। তাই হয়তো বছরে মাত্র একবারই ওঁর সঙ্গে দেখা হত।
আসলে, আমাদের গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা হত, এখনও হয়। তবে তখন সংক্রান্তির আগের দিন থেকে প্রতি সন্ধ্যায় টানা সাত দিন ধরে মেলার মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হত। এটাই ছিল মেলার 'বিশেষ আকর্ষণ'। দু'দিনের মেলা এই আকর্ষণের জোরেই সাত দিনে গিয়ে ঠেকত। প্রতিদিন দুটো করে শো হত। সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত দশটা অব্দি, প্রথম শো। রাত দশটা থেকে একটা অব্দি, দ্বিতীয় শো। পাড়ায় পাড়ায় সস্তার সিডি প্লেয়ার এসে যাওয়ার পর এটা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমি সাকুল্যে প্রায় সতেরো-আঠেরো বছর ধরে তাঁবুতে সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের গ্রামের এই তাঁবু সিনেমার একটি অসাধারণ বিশেষত্ব ছিল। সাত দিনের এই সিরিজের উদ্বোধন হত দুটি শোয়ে উত্তমকুমারের ছবি দেখিয়ে। উদ্যোক্তারা উত্তমের প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, কোনদিন এ-নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। 'বহ্নিশিখা', 'সন্ন্যাসী রাজা', 'অগ্নিপরীক্ষা', 'সাগরিকা', 'পথে হল দেরি', 'হারানো সুর', 'নায়িকা সংবাদ', 'শাপ মোচন', 'সপ্তপদী', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী', 'অমানুষ', 'আনন্দ আশ্রম', 'ওগো বধূ সুন্দরী'র মতো ছবিগুলো এভাবে এখানেই জীবনে প্রথমবার দেখেছি। কোন-কোনটা দ্বিতীয়বারও।ইস্টম্যান কালার ও রঙিন ছবির রমরমার যুগে জন্মেও বারে বারে সাদাকালোয় মুগ্ধ হয়েছি। 'দেবদাস' বা 'প্রতিশোধ' ছবিতে উত্তমকুমারের ভূমিকা ছিল সহঅভিনেতা বা পার্শ্ব-অভিনেতার। কিন্তু, সেই সময়ে আমাদের বিশ্বাসে-ভালোবাসায় এ-ছবিগুলোয় উত্তমকুমারই নায়ক ছিলেন, এগুলো উত্তমকুমারেরই 'বই' ছিল।
তখন বোধহয় বছর পাঁচেক বয়স। ওই বয়সের স্মৃতি বড্ড ছায়াঘেরা। আবছায়াময়। মুগ্ধতাময়ও বটে। রাতের শো-তে দেখতে গিয়েছিলাম, 'সন্ন্যাসী রাজা'। মায়ের সঙ্গে। গাজনের সময় বাড়িভর্তি লোকজন-আত্মীয়স্বজন। সবার জন্য খাবার বানিয়ে-টানিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অবসর মা'র কোনদিনই সন্ধ্যের শোতে হয়নি। সেদিনও হল না। সারাদিন হুড়োহুড়ি-ছোটাছুটি-খেলাধুলোর ক্লান্তি পেরিয়ে রাত দশটা বা তার পর সেই পাঁচ বছরের 'আমি'-র জেগে থাকার কথা নয়। তবুও জেগে ছিলাম বোধহয় 'সিনেমা'-নামক মোহময় জিনিসটার আকর্ষণে। কিম্বা, এমনও হতে পারে, বেমালুম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর ঘুমন্ত 'আমার' ভারি শরীরটা কোলে তুলে মা নিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল, সিনেমা শেষ করে ফিরতে ফিরতে তো সেই রাত দুপুর--যদি তার মধ্যে আমার ঘুম ভেঙে যায়! যদি ঘুম ভেঙে মাকে হাতড়ে পাশে না-পাই! যদি না-পেয়ে ভয় পাই! যদি কান্নাকাটি করি!--কোলের সন্তানের জন্য মায়েদের যত রকম ভাবনা থাকে, সেইসবটুকু ভেবেই বোধহয় মা তার সমস্ত ক্লান্তি অগ্রাহ্য করে আমায় বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কোলের ছেলেমেয়েদের টিকিট লাগত না, আমারও নিশ্চয় লাগেনি। তাঁবুতে ছেলেদের বসার জায়গা ও মেয়েদের বসার জায়গা লম্বালম্বি বাঁশ বেঁধে আলাদা করা। আমি বসেছিলাম স্বাভাবিকভাবেই মায়ের সঙ্গে মেয়েদের দিকে।
ছবি কীভাবে শুরু হল, কখন শুধু হল আমার কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে পড়ছে--তাঁবুতে আবছা আলো, আলো কেবলই পর্দা জুড়ে, সেখানে নিরন্তর চলমান সাদাকালো ছবি। আর মায়ের পাশে মাটিতে বসে কিছুতেই আমি পর্দার ওপরের আদ্দেকটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সামনের মহিলাদের উঁচু উঁচু মাথা নীচের আদ্দেক পর্দা ঢেকে দিয়েছে। পর্দায় তখন প্রবল লাঠিখেলা চলছে। সেই খেলায় সবাই মুগ্ধ, সবাই ভেতরে-বাইরে উত্তেজিত। আমার মাও। মা এখন পুরোপুরি পর্দায় ডুবে গেছে, আমার দিকে দেখছেই না! এখন আমার অভিমান করার সময় না, সবাই মশগুল হয়ে দেখছে, আমাকেও লাঠিখেলা দেখতে হবে! আমি উঠে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, এই তো এবার দারুণ দেখতে পাচ্ছি! একটা সুন্দর দেখতে লোক, লাঠি বাগিয়ে চমৎকার টেক্কা দিচ্ছে। ছেলেদের দিকে চমৎকার হাততালি বেজে উঠল। আর তখনই পেছন থেকে কে যেন রুক্ষ্ম হাতে আমার ঘেঁটি ধরে টেনে বসিয়ে দিল। মাকে কথা শোনাতেও ছাড়ল না। তখন বোধহয় মায়ের খেয়াল হল আমার দিকে। একটু লজ্জিত হয়ে টেনে নিল আমার পরম আশ্রয়, তার কোলে। আর আশ্রয় থেকে বেরুতে দিল না। মায়ের কোলে একটু ঘাড় উঁচিয়ে শেষ অব্দি বসে রইলাম। পুরো ছবিটা দেখলাম। দেখলাম, সেই সুন্দর লোকটাকে। বদমাশ ডাক্তারটার বদমাইশির জন্য তার সব সুখ চলে গেল, একদিন মরেও গেল, তারপর সাধুদের চেষ্টায় আবার বেঁচে উঠল, সাধুদের সঙ্গে থেকে রাজা থেকে সে সাধু হয়ে গেল, তারপর একদিন রাজ্যে ফিরে এলো, অথচ সে যে মরেনি বেঁচে আছে--প্রথমে এটা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইল না, শেষমেশ প্রজারা বিশ্বাস করে বদমাশটাকে শাস্তি দিল, তারপর সাধুকে আবার রাজা হতে বলল; কিন্তু, সাধু আর রাজা হতে চাইল না, রাজপাট ছেড়ে চলে গেল। আর দেখলাম, সেই সুন্দর লোকটা যতক্ষণ দুঃখ পেল, কষ্ট পেল--আমার মা ততক্ষণ তার জন্য নীরবে ফুঁপিয়ে চোখের জল ফেলল। আমি মায়ের বুকে লেপ্টে সবটা টের পেলাম। লোকটার শোকদুঃখে কাতর হবার বয়স আমার নয়, তবু কেমন করে যেন মায়ের কষ্ট আমার বুকেও ছড়িয়ে গেল। লোকটার জন্য আমারও কষ্ট হতে লাগল, লোকটা আমায় কষ্ট দিয়ে আমাকেই আপন করে নিল!
শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে সেইসব দিন একদিন চলে গেল। লোকটার নাম যে, 'উত্তমকুমার'--এও একদিন জানলাম। কবে জানলাম, জানি না। শুধু জানি, আমার আকাশ হয়ে যাওয়া মায়ের নিবিড় আশ্রয়-হৃদয়ের শব্দ-সুধা ভালোবাসার একটি স্তরের আমূল অনুষঙ্গ হয়ে আছে ওই লোকটা। অন্তরলোকের মানুষ হয়ে আছে, আজও!