তখনও মোবাইল আসেনি। ল্যান্ডলাইনের যুগ। স্যাটেলাইট চ্যানেল আসবে আসবে করছে। ছাদে উঠলেই কাক বসা এরিয়াল অ্যান্টেনা দেখা যায়। ফি রবিবার দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘর ছোঁয়ার আগেই একবার করে ঘুরে আসতে হয় ছাদ থেকে। ‘অ্যান্টেনা ঠিক আছে কিনা’।
টিভি বস্তুটা যে নেশার জিনিস চিনতে শিখছি একটু একটু করে। শুধু বেছে দেওয়া কার্টুন দেখায় একটু আধটু দেখার ‘পারমিশন’।
কিন্তু রবিবার চারটে বাজলে যেন আলগা হয়ে যায় শাসন-নজর গুলো। সেদিন বাড়ির হাওয়ায় একটাই নাম ভাসতে থাকে ‘উত্তমকুমার’।
উত্তমকুমারের সিনেমা থাকলে সেদিন বড়দের ফুরফুরে মন। বাবার শরিফ মেজাজ। মায়ের রান্না শেষ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। সেদিন আর টিভির সামনে বসলে মানা নেই।
যার সিনেমায় মারপিট থাকে না। ভয় থাকে না। রক্ত থাকে না। চেনা-চেনা গান গেয়ে যায় লোকটা। বাবার গলায় যেসব গান শুনতে শুনতে থালার ভাত শেষ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। অন্ধকারে ঘুম চলে আসে। সবই যেন চেনাজানা। শুধু লোকটার সঙ্গে সত্যি সত্যি দেখা হয় না কোনওদিন।
উত্তমকুমার। অনেক বড় বয়স পর্যন্ত এক ‘ম্যাজিক পার্সনালিটি’। সিনেমা আর অভিনয়ের টেকনিক্যাল শব্দ আর বিচার বিশ্লেষণ জানার বয়স তখন হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য রকম ভালো লাগত তাকে। বালিকা বয়সের ছোট্ট জগতে এত সুন্দর দেখতে মানুষ আর দেখা হয়নি।
বড় হতে হতে সেই মুগ্ধতায় ‘লজিক’, ‘কারণ’ এর ছোঁয়া। স্কুল পার হয়ে ছোটবেলার মুগ্ধতা তখন একটু ফিকে। তবে এক অন্য টান।সত্যজিৎ সিরিজে এর মধ্যেই দেখা হয়ে গিয়েছে ‘নায়ক’। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে ‘সব্যসাচী’। সিনেমার ন্যারেশন টানে। ক্যামেরা ভাষায় ভাবাতে চায়। উত্তমকুমার এক ম্যানারিজম।
‘ডক কর্মী’ থেকে ‘ম্যাটিনি আইডল’ এক অসাধারণ রূপকথা। কতভাবে ভাবাতে পারেন।
যত বয়স বাড়ে তত বদলে যায় দেখা। তবে মুগ্ধতা কমে না। বদলে যায় মাত্র। তাই আজও রাত জাগিয়ে রাখে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’। ভিনদেশি ভালোবাসার কী অসাধারণ কাব্য। শুধু দেখা দিয়েই বদলে দিতে পারেন মনের ঘরের রঙ। নিজের বুকের মধ্যে কতটা ভালোবাসা আর প্যাশন থাকলে এভাবে ডুব দেওয়া যায় গল্পে তা সাধারণ বোধ বুঝে উঠতে পারে না। শুধু হৃদি ভেসে যায় পায়রা চোখের পর্তুগীজ সাহেব আর বাঙালি সৌদামিনীর প্রেমের টানে।