উত্তম কুমারের মৃত্যুদিন আমরা যে-আবেগে মনে রেখেছি, জন্মদিন সে-আবেগে মনে রাখিনি। সে যে কবে আসে, আর কবে চলে যায়; আমরা লোকসাধারণ তার খেয়াল রাখি না। কিন্তু, এই আমরাই চব্বিশে জুলাই, তাঁর মৃত্যুদিন, কক্ষনো ভুলি না। কেন ভুলি না, তার কারণও আছে যথেষ্ট।
চারের দশকের শেষ দিকে উত্তম কুমার যখন চিত্রজগতে এলেন, তখন তেমন কোন শূন্য জায়গা ছিল না, যেটা তাঁর আগমনে ভরাট হয়েছে।
আসলে, সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন আমাদের কাছে উপরিপাওনা। কারণ, সে-সময় প্রমথেশ বড়ুয়া, অহীন্দ্র চৌধুরি, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস প্রমুখ সুদর্শন ও সু-অভিনেতারা নক্ষত্র হয়ে জ্বল জ্বল করছিলেন।
কিন্তু, উত্তম কুমারের হঠাৎ মৃত্যু বাংলার পুরো সিনেমাজগতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সিনেমায় বাঙালিয়ানার যুগটাও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আসলে, উত্তম বেঁচে থাকতেই বাংলার সিনেমা-স্রোত হিন্দি সিনেমার আঙ্গিকের মধ্যে নিজেকে বিলীন করতে শুরু করেছিল, তাঁর মৃত্যুতে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করে ফেলল। বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-নির্ভরতার একটা সাময়িক বন্ধ্যাদশা শুরু হল। বাংলা সিনেমা তৈরি হওয়া কমে গেল। এই সামগ্রিক অচলাবস্থা কম-বেশি তিন-চার বছর চলল।
সর্বোপরি, 'মৃত্যু' উত্তম কুমার মানুষটাকে বুড়ো হতেই দিল না। আমাদের কাছে আজীবন সুদর্শন 'মহানায়ক' করেই রেখে দিল। এই সবটা মিলিয়ে উত্তম কুমার মৃত্যুদিনেই আমাদের কাছে আজ চল্লিশ বছর পেরিয়েও প্রবলভাবে বেঁচে আছেন।
বেঁচে রয়েছে সেলুলয়েডে চিরস্মরণীয় সব সিনেমায় তাঁর অভিনীত অবিস্মরণীয় সব মুহূর্ত। সেই সব মুহূর্তে তাঁর দুরন্ত অভিব্যক্তি দেখে তাঁকে এবং তাঁর অভিনীত চরিত্রকে সবসময়ই গুলিয়ে ফেলেছি। 'নায়ক' ছবিতে 'yes, I will go to the top!' 'তাঁর' নায়ক হয়ে ওঠারই জেদ বলে বিশ্বাস করেছি; আঙুলের ফাঁকের অমোঘ সিগারেট, ঠোঁটের ফাঁক বেয়ে উঠে আসা ধোঁয়ার বৃত্ত নায়কত্বের চরম পরাকাষ্ঠা বলে পোষণ করেছি।
আর মনে মনে প্রশ্ন জমিয়েছি, জীবনে লোকটার প্রথম সিগারেট খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল? উত্তর পেয়েছি একদা তাঁরই কথিত কাহিনি, অর্থাৎ আত্মজীবনী 'আমার আমি'-তে; সেটাই একটু নিজের মতো করে বলছি, শুনুন :
উত্তম কুমার তখন কেবলই 'অরুণ'। ছবিতে আসবেন, নাম বদল হবে—এসব অনেক পরের ভবিতব্য। অরুণ তখন সবে কিশোর।
সে এক উদ্দাম কৈশোরের কাল। ভবানীপুরের পদ্মপুকুর (১৯৪২ সাল পর্যন্ত এই পুকুরটিতে সাঁতার শেখানো হত, তারপর পানীয় জল সরবরাহের জন্য সাঁতার বন্ধ করে দেওয়া হয়।) দাপিয়ে তখন সাঁতার শিখছেন, নিজেদের 'লুনার ক্লাব'-এর হাতে লেখা ম্যাগাজিনে কবিতা ও গল্প লিখছেন, 'ইন্দিরা' সিনেমার পেছনে বিখ্যাত কুস্তিগির ননী ঘোষের আখড়ায় কুস্তি শিখছেন, সুকুমার গুপ্তর কাছে লাঠি খেলা শিখছেন আর পড়ছেন সাউথ সুবার্বন স্কুলে, ক্লাস এইট কি নাইনে।
কৈশোর এমন একটা সময় যে, এ-বয়সের জন্য যা কিছু নিষিদ্ধ, গুপ্ত; সেই সব জিনিসের প্রতিই অদম্য এক স্বাভাবিক আকর্ষণ তৈরি হয়। চারপাশের দেখা থেকে মনের মধ্যে কত কত প্রশ্ন জাগে। তাতে বিষয়ের কোন বাছবিচার থাকে না।
এই যেমন ধরুন, সিগারেট। চারপাশে বড়রা আকছার ভোঁস ভোঁস করে সিগারেট ফুঁকে স্ট্রিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়ে। কাগজে কাগজে কতশত কোম্পানির হরেকরকম সিগারেটের রংদার বিজ্ঞাপন। পড়লে মনে হয় যেন ওটাই একমাত্র পৌরুষের প্রতীক। সিনেমায় নায়কের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখে, ধোঁয়া ছাড়ার আবেশ দেখে মনে হয় যেন ওটাও নায়কত্বের অন্যতম প্রতীক। চতুর্দিকে এমন করে যার এত মাহাত্ম্য প্রচারিত, ভাবলেন, চেখে দেখতে হবে তো জিনিসটা কেমন, কেন এর প্রতি সকলের এত আকর্ষণ?
এবার ঘটনাটা যে-দিন ঘটল সেদিনের কথা বলি :
সেদিন 'বিজলী' সিনেমা হলে চলছে ‘ঠিকাদার’ নামের একটি বাংলা ছবি। তখনকার মেয়েদের হার্টথ্রব নায়ক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন এ ছবিতে। (তাতে অবশ্য নায়ক দুর্গাদাসের অনুপ্রাণিত করার মতো সিগারেট খাওয়ার কোন সিন ছিল কি না জানা যায় না)। নায়িকা ছিলেন জ্যোৎস্না গুপ্ত।
'বিজলী' ভবানীপুরে অরুণদের বাড়ির প্রায় কাছের একটি হল। ফলে, বাড়ি-পালিয়ে সিনেমার পোকা অরুণের সমবয়সী ও সমব্যথী বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নুন শো-তে জমিয়ে ছবিটা দেখতে কোন অসুবিধে হল না।
তারপর ছবি একসময় শেষ হল। তখন হল থেকে বেরিয়ে প্ল্যানমাফিক একটু আড়ালে সরে গেলেন সদলে অরুণ। 'প্ল্যান' মানে, নিষিদ্ধ অথচ আকর্ষণীয় ব্যাপারটা আজই সেরে ফেলার প্ল্যান।
কাজেই, আড়ালে এসে প্রথমেই কাঁপা কাঁপা হাতে বেরুল ক্যাপস্টান ম্যাগনাম সিগারেট। তারপর দেশলাই। এবার প্রথম নিষিদ্ধ কাজটি করার উত্তেজনা ও ভয়ে হাত কাঁপতে লাগল, বুক কাঁপতে লাগল। কারণ, বাড়ির কেউ কপালের ফেরে দেখে ফেললেই ব্যস, চিত্তির!
সুতরাং, চারদিকে কয়েকজোড়া চোখের সতর্ক ও সজাগ প্রহরা শুরু হল। তার মাঝে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠির আলতো ছোঁয়ায় জ্বলে উঠল সিগারেট। প্রথম ঠোঁটের টান তামাকপোড়া গন্ধ ছড়াল। সেই গন্ধ নিষেধের বেড়া ভাঙতে হাতছানি দিল আর-সকলকে।
সেই একখানা সিগারেট এক একটানে হাতে হাতে ঘুরতে লাগল ‘রিলে’ হয়ে। ধোঁয়ায় ভরে উঠল বুক। তারপর একটু অনভ্যাসের কাশি, জিভে সামান্য তেতো, মাথায় অল্প রিমঝিম। প্রথম দিনের এই অনুভূতিটাই সারাজীবনের জন্য পেয়ে বসল।
একদা সিগারেটের আয়ু শেষ হল। তখন হুঁশ হল, মুখ খুললেই সমানে বেরুচ্ছে সিগারেটের কড়া তামাকের গন্ধ! এবার তো বাড়ি ফিরতে হবে; কিন্তু এই অবস্থায় বাড়ি ঢুকলে আড়ং-ধোলাই এক্কেবারে নিশ্চিত। এখন উপায়?
সামনেই শ্রীহরির মিষ্টির দোকান। উপায় খুঁজতে সবাই মিলে সেখানেই সটান হানা দিলেন। ভাবনাটা এমন যে, এর ওপর কচুরিমিষ্টি যা-হোক কিছু একটা খেয়ে নিলেই হল। দই, রায়তা, লেবুজল, ফল দিয়ে কত কত মাছ-মাংস আইঢাই ধামাচাপা দেওয়া গেল; আর এ তো সামান্য সিগারেটের গন্ধ! নিশ্চয়ই চাপা দেওয়া যাবে, আলবাৎ যাবে!
কনফিডেন্সের সঙ্গে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলা হল। তারপরই 'হাঃ হাঃ' করে মুখের গন্ধ শোঁকা হল। নাঃ, যেমন ছিল গন্ধ, তেমনই আছে। কিচ্ছুটি এসপার-ওসপার হয়নিকো! আচ্ছা তেএঁটে গন্ধের কবলে পড়া গেল তো! এদিকে যে বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে, তার উপায় কী হবে!
আবার শুরু হল গন্ধ-বিদেয় ভাবনপালা। হঠাৎ আইডিয়াটা দলেরই একজনের মাথায় ক্লিক করল। গন্ধ বিদেয় করতে ওডিকোলন ইউস করলে কেমন হয়!
বেশ হয়, বেশ হয়। একখানা উপায় পেয়েই সকলে একেবারে হামলে পড়ে আঁকড়ে ধরলেন সেটাকে। কারণ, উপায়টাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আগাপাশতলা ভাববার সময় একেবারেই নেই। বাড়ি ফেরার ব্যাপারে অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি হলে সিগারেটের গন্ধ লাগবে না, এমনিতেই আচ্ছা-সে উত্তম-মধ্যম জুটবে কপালে।
সুতরাং, হাতের পাঁচ টুক করে ওডিকোলন কিনে গায়ে মেখে, জিভেও কয়েক ফোঁটা ফেলে দিলেন সকলে। আর তাতেই ব্যাপারটা ক্লিক করে গেল। বেরিয়ে এল স্বস্তির নিঃশ্বাস। নাহ, গায়ে-মুখে-আঙুলের ফাঁকে কোত্থাও আর সিগারেটের গন্ধের ছিটেটুকুও নেই! বদলে, ভুরভুর করছে মিষ্টি একটা গন্ধ। আঃ, কী শান্তি!
শান্তিটুকু নিয়েই পাঁই পাঁই করে যে-যার বাড়ি ছুটলেন সকলে। পিঠ বাঁচাতে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ার একটা আজব কারণ খাড়া করে ম্যানেজ করতে হবে যে!...