এখন যেখানে নবীনা সিনেমা তখন সেই জায়গায় ছিল ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়ো। ‘তখন’ মানে চল্লিশের দশক, সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ।
‘নায়ক’ হতে চেয়ে অনেকেই আসত স্টুডিয়োর গেটে। দারোয়ান গেটেই আটকে দিত।
গিরিশ মুখার্জী স্ট্রিটের এক তরুণ একদিন গেল সেখানে। ছবিতে ডাক পেয়েছে সে। ভবানীপুর অঞ্চলে থিয়েটারে অভিনয় করে বলে লোকজন তাকে একটু-আধটু চেনে। থিয়েটারতুতো দাদার সুপারিশে মিলেছে ছবিতে সুযোগ।
দারোয়ান বাধ্য হল ভিতরে ঢুকতে দিতে।
রোগা-ঠ্যাঙা চেহারা। পোর্ট-কর্পোরেশনের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে কেরানী। চেহারায় সে ছাপও স্পষ্ট। দুরু দুরু বুকে ফ্লোরে।
আজ তার প্রথমদিন। এই স্টুডিয়ো যেন তার কাছে তীর্থস্থানের মতো।
ফ্লোরের দিকে তাকাতেই দেখে মাঝখানে একটা চমৎকার বিয়েবাড়ি। বাড়ি ঘিরে লোকজন। দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল। ততক্ষণে ভয় কেটে গিয়েছে। বুকের মধ্যে একটা আনন্দের নদী বইছে তিরতিরিয়ে।
সেই দাদা তাকে নিয়ে গেল পরিচালক মশাইয়ের কাছে। এবার যেতে হবে মেকআপ রুম।
একেবারে বর বেশে সাজানো হল। সেখান থেকে শুটিং ফ্লোরে।
সিনে মার খাওয়ার দৃশ্য আছে শুনে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিল ছেলেটা। সে কথা মুখে বলতেই হেসে উঠেছিল গোটা ফ্লোর। খুব অপ্রস্তুত হয়েছিল। সেই তার প্রথম ক্যামেরার সামনে আসা। জীবনের প্রথম অভিনয়। তবে ‘এক্সট্রা’ হিসেবে। পারিশ্রমিক দৈনিক পাঁচ সিকি।
সেই ছবি মুক্তির আলো দেখেনি কোনওদিন। ছবির নাম মায়াডোর। হিন্দি ছবি। সন ১৯৪৭।
নবাগত অভিনেতাটির নাম অরুণ চট্টোপাধ্যায়। আগামীর ‘উত্তম’।
অরুণ থেকে উত্তমে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় শুধু আলো আর আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কাছে গেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে গহ্বর আর ছড়ানো কাঁটা।
‘এক্সট্রা’ থেকে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে ওঠা। যেন এক জাদু বাস্তব, কিন্তু আলোর পর্দা সরালেই দমচাপা আঁধারের গল্প। আলোয় ফেরার লড়াইটাই যেন সেই জীবনের আসল নায়ক।
প্রথম ছবি মুক্তি না পাওয়ায় হতাশা থাকলেও সেদিন দমে যায়নি গিরিশ মুখার্জী স্ট্রিটের ছেলেটা। ততদিনে ক্যামেরার সামনে অভিনয়ের নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। পুরনো চাকরীর জীবনে আর তার মন টেকে না। জানে পথ অজানা।
হতাশাকে সে কাছে আসতে দেয় না ফের জ্বলে ওঠার আশায়।
এক বছরের মধ্যেই আবার সুযোগ এল, অন্য ছবিতে। ছবির নাম ‘দৃষ্টিদান’। ছোট পার্ট। সে রাজি হয়ে গেল।পারিশ্রমিক সাতাশ টাকা। কাজ করল ছবিতে। কিন্তু পারিশ্রমিকের পুরো টাকা তার রইল না। ‘কমিশন’ দিতে হল সুযোগ পাওয়ার। হাতে এল সাড়ে তেরো টাকা।
সেই ছবি রিলিজ হয়েছিল। তারপর থেকে আসতে লাগল ছবির অফার। ছবির দুনিয়ায় নতুনদের পথ কাঁকর-বালি-কাঁটার পথ। সেই পথ ধরেই হাঁটতে লাগল।
সিনিয়র বলে যাঁদের চিনত সেইসব মুখগুলো রাতারাতি যেন বদলে যেত লাগল শুটিং ফ্লোরে। নবাগত অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের চোখের ওপর।
একদিনের ঘটনা।
তখন ইন্দ্রপুরীতে ‘কামনা’ ছবির শুটিং চলছে। অন্য ফ্লোরে ‘দেবী চৌধুরানী’। ছবির নায়ক প্রদীপকুমার।
খুব কৌতুহল নিয়ে শুটিং দেখতে গেল। সামনেই তার ‘শেতলদা’। ম্যাটিনি হিরো প্রদীপকুমার। তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে অ্যামেচার থিয়েটার করত সে।
দেখেই কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “শেতলদা কেমন আছেন?”
কোনও উত্তর এল না। আবার জিজ্ঞাসা করল সে। এবারও সাড়া নেই। বারকতক জিজ্ঞাসা করার পর ‘শেতলদা’ উত্তর দিলেন, “ তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না”।
লজ্জায়, অপমানে মরমে মরে গিয়েছিল সে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল কাজের জায়গায় ‘সেন্টিমেন্ট’ রাখতে নেই।
ফ্লোরে এক সিনিয়র অভিনেত্রী সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, “ এত দুঃখ পেতে নেই...নাম হলে সবাই অতীত ভুলে যায়...তুমি হয়ে যাতে আমাদের ভুলে না যাও তাই দেখো...”
সিনিয়রের কথা মনে রেখেছিল ছেলেটা। নিজের জীবনে সাফল্যের মধ্য গগনে পৌঁছেও সে ভুলে যায়নি নিজের অতীতের পথ।
পরপর ছবিতে সুযোগ সে পেয়েছিল। হয়ত ভাগ্যের জোরেই। টানা ফ্লপের হ্যাট্রিকেও মিলেছিল সুযোগ। বদলাতে হয়েছিল নিজেকে। নামটাকেও।
বারবার ফ্লপের দৌলতে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ফ্লপ মাস্টার জেনারেল। আড়ালে নয় সামনে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করত ইউনিটের লোকজন। কেউ তেমন একটা আমল দেয় না।
শুটিং ফ্লোরে একদিন কে যেন বলল, “এ কলির ভীমকে কোথা থেকে এনেছেন?”
নানা বাঁকা কথা। বিরূপ মন্তব্য। মন নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতিই তাকে শিখিয়ে দিল খারাপ কথায় কান দিতে নেই। বাজে লোকেদের থেকে দূরে থাকতে হয়। টিকে থাকতে গেলে এসবে ভেঙে পড়লে চলবে না।
পরিশ্রম, পরিশ্রম আর পরিশ্রম। লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজেকে গড়ার কাজে মন দিল সে। একদিন আবিষ্কার করে ফেলল অকাজের লোককে বাগে আনতে মিষ্টি ব্যবহার, চা আর সিগারেট এই তিনের কোনও বিকল্প নেই!
ছবির ভাগ্য যাদিও বদলালো না। ফ্লপ, ফ্লপ আর ফ্লপ। নাম বদলেও সুবিধা এল না। চরম দুর্বিষহ দিন। কারও মুখের দিকে তাকাতে পারে না ব্যর্থতার ভারে। প্রতিবার নিজেকে নিংড়ে দেয় ক্যামেরার সামনে তবু প্রসন্ন হন না ভাগ্যদেবী।
শেষ পর্যন্ত ঘুরেছিল একদিন চাকাটা। তার ফ্লপের ইতিহাস জেনেও তার সঙ্গে চুক্তি করেছিল এম পি প্রোডাকশন হাউস। এক বছরের চুক্তি। মাসে মাসে চারশো টাকা মাইনে। তবে অভিনয়ের পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা নিয়েছিলেন প্রখ্যাত নট সন্তোষ সিংহ। পাশ হয়ে গিয়েছিল সে।
পরে তাঁর কাছেই অভিনয় শেখার জন্য নাড়া বেঁধেছিল সে। একেবারে নতুন শুরু।
১৯৪৮-১৯৫২ টানা চলেছিল লড়াই। বারবার এসেছে ব্যর্থতা। এক সময় সাল-তারিখ-দিনগুলোতেই ঘেন্না ধরে যাচ্ছিল। পতনের সব আয়োজন যখন প্রায় সম্পূর্ণ, তখন একদিন আচমকাই ঘুরে গিয়েছিল ভাগ্যের চাকাটা।
তার জীবনে এল সুখেন। ‘বসু পরিবার’-এর জ্যেষ্ঠপুত্র।
বিপর্যয়ে পড়া পরিবারকে কীভাবে তীরে এনে তোলে সে এই নিয়ে কাহিনী।
সাফল্যের শুরুটা এখান থেকেই। ছবি অর্থ আনল প্রযোজকের ঘরে। কাগজে প্রশংসা। রাতারাতি বদলে গেল জীবন।
আগুনে পুড়ে খাদহীন নবজন্ম।
অরুণ চট্টোপাধ্যায় হল পাকাপাকি উত্তমকুমার।
ছবির জগতে ‘নবাগত’দের শুরু ঠিক কেমন হয় খুব ভাল ভাবে জানতেন বলেই তাদের সমব্যাথী ছিলেন আজীবন। তারকার আলো নিভে গেলে তাকে কীভাবে বাতিল করে এই কৃত্রিম আলোর দুনিয়া সেই ছবিও তাঁর নিজের চোখে দেখা তাই প্রবীণ শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে দু’বার ভাবেননি কোনওদিন।
অনেকটা আঁধার সাঁতরে আলোয় এসেছিলেন বলে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি নিকষ কালো অন্ধকারকে। জানতেন কোনও উজ্জ্বল আলোই দীর্ঘস্থায়ী নয় তাই জ্বালিয়ে রাখতে হয় অন্তরের আলো। সেইভাবেই তাঁর নক্ষত্র হয়ে ওঠা। এক নাছোড় জেদের নাম উত্তমকুমার।