উৎপল দত্তঃ নাটক থেকে সিনেমায়

১৯৫০ সালের ১৪ জুলাই রূপবাণী, অরুণা ও ইন্দিরা সিনেমায় একযোগে মুক্তি পেয়েছিল মধু বসু পরিচালিত ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিটি। এই ছবিটির মধ্য দিয়েই বাহুমাত্রিক অভিনেতা উৎপল দত্তের চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। ১৯৫০ সালের ২১ জুলাই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলঃ ‘নবাগত শ্রীউৎপল দত্ত নামভুমিকায় অভিনয় করিয়াছেন। তাঁহার অভিনয় এমনই বিস্ময়কর যে, মনে হয় এই চরিত্রটি রূপদানের জন্যই যেন তাঁহার জন্ম সার্থক।’

‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে অভিনয়ের সময় উৎপলের বয়স মাত্র বিশ বছর। এই বয়সে প্রথম ছবিতে তিনি অভিনয়ের জন্য এই যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলেন, তার জন্য ফাদার উইভার-এর অবদান কম ছিল না। কেননা, কৈশোরে উৎপলের অভিনয়সত্তাকে লালন করেছিলেন তিনিই।

আসলে, উৎপল দত্তের মামাবাড়ি ছিল শিলং-এ। ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ সেখানেই তাঁর জন্ম হয়। ছেলেবেলাও কাটে সেখানেই। সেখানকার সেন্ট ক্রেডমন্ট হাই স্কুলে প্রাথমিক পড়াশুনো সেরে তারপর তিনি আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন এসে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে। এখানেই তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ফাদার উইভারকে।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশুনোর অঙ্গ হিসেবেই সে-সময় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত পাশ্চাত্য নাটকের চর্চা হত। এতে নেতৃত্ব দিতেন ফাদার উইভার। একদা ছাত্র হিসেবে উৎপলও এই চর্চার অংশ হলেন এবং ফাদারের স্নেহচ্ছায়ায় শিক্ষা নিয়ে দাপিয়ে অভিনয় করতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, ফাদারের কাছে তিনি সেক্সপিয়র আত্মস্থ করে, তাঁকে ভালবাসতে শিখলেন- যা হয়ে উঠেছিল তাঁর আজীবনের সম্পদ।

সমৃদ্ধির এই পর্ব চলতে চলতেই নিয়ম মেনে এক সময় ফাদার অন্যত্র বদলি হয়ে গেলেন। মাস্টারমশাই চলে গেলেন বটে, কিন্তু তিনি যে শেক্সপিয়রচর্চার জোয়ার এনেছিলেন, শিক্ষায়তনে তাকে থামতে দিলেন না উৎপল। তিনি ‘অ্যামেচার শেক্সপিরিয়েন্স’- নামের একটি দল তৈরি করে নিয়মিত অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলেন।

এমনি করে স্কুলের পাঠ চলতে চলতেই এল ১৯৪৭ সাল। এই সময় দেশের নানান প্রান্তে ব্রিটিশ নাট্যগোষ্ঠী ‘শেক্সপিরিয়ান ইন্টারন্যাশন্যাল থিয়েটার কোম্পানি’ নাট্যাভিনয় করে বেড়াচ্ছিলেন। ঘটনাক্রমে তাঁরা কলেজের নাট্যাভিনয়ে উপস্থিত থাকার এবং উৎপল দত্তের অভিনয় দেখার সুযোগ পেলেন। উৎপলের অভিনয় তাঁদের এত ভালো লাগল যে, তাঁরা উৎপলকে নিজেদের দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

 

UtpalDutta1

 

সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উৎপল তাঁদের দলে যোগ দিলেন। কারণ, অভিনয় করতে করতে উৎপলের মনে হচ্ছিল যে, কলেজের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তর শিক্ষিত মানুষের কাছে সেক্সপিয়রকে মঞ্চ-মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া দরকার। দেখলেন, ‘শেক্সপিরিয়ান ইন্টারন্যাশন্যাল থিয়েটার কোম্পানি’ মূলত সেই কাজটাই করছেন। ফলে, তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটাই সমীচীন মনে করলেন। তারপর তাঁদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন প্রান্ত-ভ্রমণে।

ভ্রমণ সেরে ফের কলকাতায় ফিরে তিনি যখন তাঁদের সঙ্গে চুটিয়ে ‘ওথেলো’ নাটকে অভিনয় করছেন, তখন ওদিকে চিত্রপরিচালক মধু বসু ‘মাইকেল মধুসূদন’-এর চিত্রনাট্য লিখে মধুসুদন চরিত্রের জন্য অভিনেতা খুঁজছেন। তার কিছু আগে (১৯৪৩ সালে) নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নাটকে মাইকেল চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিলেন। সে-কথা মাথায় রেখেই প্রযোজকমশাই মধু বসুর কাছে প্রস্তাব করলেন শিশির কুমারের নাম।

শিশির কুমার অসম্ভব ভালো অভিনেতা। তবু প্রযোজকের প্রস্তাবে মধু বসু সম্মত হতে পারলেন না। কেননা শিশির কুমার যুবক নন। যে সময় এই প্রস্তাবনা, সেই সময় তাঁর বয়স ষাটের দোরগোড়ায়। অথচ মধু বসু তাঁর ছবির জন্য যুবক মধুসূদনকে চাইছেন।

চাইছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না কোথাও। যিনি অভিনয় করবেন, তাঁর চেহারায় মাইকেলের কাছাকাছি আদল একটা থাকতেই হবে। সব চেয়ে বড় কথা, বাংলার সঙ্গে তাঁর ইংরেজিটাও ভালো জানা দরকার। নইলে উচ্চারণে আনাড়িপনা ধরা পড়বে যে!

ফলে অভিনেতার সন্ধানে বাংলা নাটকের মঞ্চে তিনি যেমন নিয়মিত হানা দিচ্ছিলেন, তেমনি ইংরেজি নাটকের মঞ্চেও দিতে শুরু করলেন। এইভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি ‘শেক্সপিরিয়ান ইন্টারন্যাশন্যাল থিয়েটার কোম্পানি’‘ওথেলো’র শো-য়ে হাজির হলেন।

‘ওথেলো’তে উৎপলকে দেখে মধু যেন চমকে গেলেন-এ যে সাক্ষাৎ মাইকেল! দীঘল দুই চোখ, টিকলো নাক-মুখের গড়ন ঠিক যেন তাঁরই মতো! ছুটলেন সাজঘরে। কাছ থেকে দেখে বুঝলেন পরিচালকের দৃষ্টি মেকাপের আবরণেও বিভ্রান্ত হয়নি। কথা বলে বুঝলেন, ইংরেজিতে নাটক করেন ঠিকই, তবে বাংলাতেও তুখোড় উৎপল। আর অভিনয়? তাতেও একেবারে ওস্তাদ।

কাজেই আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ রইল না। উৎপলকে মাইকেলের চরিত্রে নির্বাচন করে মধু বসু শুরু করে দিলেন শ্যুটিং। তারপর আর কী…প্রথম ছবিতেই অভাবনীয় সাফল্যের মধ্য দিয়ে চিত্রজগতে উৎপল দত্তের অভিষেক হল। রচিত হল ১৯৫০ থেকে ১৯৯৩- দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরের বহুমাত্রিক চরিত্রাভিনয়ের চিরস্মরণীয় ধারাপথ, বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি তিনটি ভাষার স্রোত বেয়ে…

বস্তুত, নাটকের জগত থেকে উৎপল ছায়াছবির জগতে এসে পড়লেও নাট্যজগতকে কখনই বিদায় জানাননি। বরং প্রথম ভালোবাসাকে নিজের রাজনৈতিক চেতনার, প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। ক্রমে চিত্রপরিচালনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ভালোবাসাকেও তার মধ্যে সামিল করেছিলেন। হয়ে উঠেছিল প্রকৃত অর্থেই দায়বদ্ধ এক প্রনম্য শিল্পী…

ঋণঃ ‘সোনার দাগ’- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...