পৃথিবী বদলে বদলে যায়। সৃষ্টির পৃথিবী। আশ্চর্য রকমভাবে। এই যেমন উদয়শঙ্করের হওয়ার কথা ছিল চিত্রশিল্পী, বদলে, হয়ে উঠলেন বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। আসলে, এই ক্ষেত্র বদলে যাওয়ার মূলে প্রতিবেশ, যোগসূত্র ও প্রতিভাই হয়ে ওঠে আসল ফ্যাক্টর, যা উদয়শঙ্করের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য।
প্রখ্যাত আইন ব্যবসায়ী শ্যামশঙ্কর চৌধুরী ছিলেন যেমন বড়লোক, তেমনি শিল্পরসিক মানুষ। শিল্পমাধ্যমের বিভিন্ন ধারার প্রতি তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ, ভালোবাসা ও চর্চা। পিতার এই গুণটি ভালোভাবেই বর্তে ছিল পুত্র উদয়শঙ্করের মধ্যে।
ফলে, উদয়শঙ্কর বাল্যেই রপ্ত করে ফেলেছিলেন মূকাভিনয়, ম্যাজিক, কিছু কিছু নৃত্যকৌশল, সাইকেল নিয়ে সার্কাসের বহুবিধ ট্রিকস এবং চিত্রশিল্প। তবে, সেই বয়সে তাঁর সাধ হল কেবল চিত্রশিল্পী হতেই। তাই অবিলম্বে পাড়ি দিলেন লন্ডনে, রয়্যাল কলেজ অব আর্ট থেকে এ-বিষয়ে পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করতে।
রয়্যাল কলেজে এসে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেলেন বিখ্যাত শিল্পী উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে। অচিরেই হয়ে উঠলেন তাঁর প্রিয়তম ছাত্রদের একজন। কেননা রদেনস্টাইন তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল চিত্রশিল্পীকে। তাই পাশ্চাত্যের আবর্তনের বাইরে এনে তাঁকে একে একে সযত্নে চিনিয়ে দিতে শুরু করলেন ভারতীয় চিত্রশিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যমালা। তাঁর এবংবিধ শিক্ষায় উদয়শঙ্কর যখন আপন চিত্রধারাকে স্বকীয়তার পথে চালিত করার প্রয়াস চালাচ্ছেন, তখনই প্রস্তুত হয়ে গেল তাঁর শিল্প-জীবনের ক্ষেত্র-বদলের পশ্চাৎভূমি:
সময়টা বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক। উদয়শঙ্কর তখনও লন্ডনে। নিজের কাজে বাবা শ্যামশঙ্কর এই সময় সেখানে খুব যাওয়া-আসা করছেন। থাকছেন। রাজপুরুষদের সঙ্গে ওঠা-বসা চলছে। এরই মাঝে তাঁর এক অদ্ভুত খেয়াল চাপল মাথায়, ইচ্ছে হল লন্ডনের বুকে একখানা নৃত্যনাট্য নামিয়ে সবাইকে বেশ তাক লাগিয়ে দিতে হবে।
ব্যস, যেমন ভাবা, তেমন কাজ। নিজেই লিখে ফেললেন আরব্য-রজনীর ধাঁচে একখানা নৃত্যনাট্য। নাটকের নৃত্যপরিকল্পনার জন্য পুত্র উদয়শঙ্করকে টানলেন দলে। শুরু হয়ে গেল মহড়া।
কালক্রমে নাটকটিতে উদয়শঙ্কর শুধু নৃত্যপরিকল্পনাই করলেন না, পোশাক-পরিকল্পনা প্রভৃতিও করলেন। এবং, তাতে ভারতীয়ত্বও মুন্সিয়ানার সঙ্গে বজায় রাখলেন। নাটকের শো অনুষ্ঠিত হল 'কনভেন্ট গার্ডেন'-এ।
ঘটনাক্রমে অনেক রাজা-মহারাজা, ইংরেজ রাজপুরুষের সঙ্গে নাটকের এই শো দেখতে এলেন রাশিয়ান ব্যালের বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভা। ভারতীয় নৃত্যশৈলী নিয়ে তাঁর দারুণ দুর্বলতা। এই শৈলীকে তাঁর ব্যালেতে সংশ্লিষ্ট করার পরিকল্পনা তাঁর ভেতরে ভেতরে আগে থেকেই চলছিল।
ফলে, নাটকে উদয়শঙ্করের ভারতীয় ঐতিহ্যমাখা নৃত্যপরিকল্পনা দেখে আনা এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, উদয়শঙ্করের সঙ্গে যেচে আলাপ করলেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে ও চেহারা দেখে বলেই ফেললেন যে, উদয়শঙ্করের জন্মই হয়েছে নাচের জন্য। তার সঙ্গে এও ঘোষণা করলেন যে, তাঁর ট্রুপে উদয়শঙ্করকে চাই!
ব্যস, উদয়শঙ্করও এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। ঘটে গেল শিল্পীজীবনের পথ বদল। শিক্ষক রদেনস্টাইন এ-ব্যাপারে খানিক গাঁইগুঁই করে বাধা দিলেও বাবার পূর্ণ সম্মতি পেলেন উদয়শঙ্কর। মূলত তাঁর উৎসাহেই উদয়শঙ্কর যোগ দিলেন আনার ট্রুপে। এবং অতি অল্পদিনেই শিখে ফেললেন ব্যালের কৃৎ-কৌশল। মাত্র দেড় বছরের সান্নিধ্যেই আনার কাছে এমন সুশিক্ষা পেলেন যে, ট্রুপের জন্য পর পর নির্মাণ করে ফেললেন ভারতীয় ঐতিহ্যময় দু'-দু'খানা ব্যালে--'অ্যান ইন্ডিয়ান ম্যারেজ' এবং 'রাধা-কৃষ্ণ'। দু'খানা ব্যালেই এমন জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পেল যে, উদয়শঙ্করকে সেটা নিজে কিছু করতে দারুণভাবে উৎসাহিত করল।
অবিলম্বেই উদয়শঙ্কর নিজের ট্রুপ তৈরি করলেন। নিজস্ব উদ্ভাবনার সঙ্গে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ভরতনাট্যম-কথাকলি, বিভিন্ন লোকনৃত্য, মূর্তি-ভাস্কর্যের বিভঙ্গ ও ব্যঞ্জনাকে এমন দক্ষতায় নিষিক্ত করলেন যে, তা থেকেই তৈরি হল তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর। তৈরি হল ব্যালের ভারতীয় ঘরানা। আর এ-সমস্তই সম্ভব হয়েছিল শিল্পের প্রতি, শিল্পীর প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা থেকেই। এ-প্রসঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর 'আমার দাদা' নামের স্মৃতিমূলক একটি রচনায় একখানা গল্প শুনিয়েছেন, সেটাই ছোট্ট করে বলি:
উদয়শঙ্করের মামাবাড়ি নসরতপুরে। সেখানে হোলি উৎসবে মাতাদিন নামের এক মুচি নেংটি পরে অদ্ভুত এক ধরণের নাচ করতেন। ঢোলকের তালে। নৃত্যকালে তাঁর বিভঙ্গ ও অভিব্যক্তি ছিল অসাধারণ। উদয়শঙ্কর যখন নিজস্বতার মধ্যে এই সব লোকজ নৃত্যশৈলীকে আত্মীকরণ করতে শুরু করেছেন সচেতনভাবে, তখনই একদিন মামাবাড়িতে এসে মাতাদিনের নাচের আয়োজন করলেন। সে-বার মনপ্রাণ উজাড় করে মাতাদিন এমন মনোমুগ্ধকর নাচ নাচলেন যে, উদয়শঙ্কর একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন। সেই মুগ্ধতায় তিনি ছুটে গিয়ে মাতাদিনকে জড়িয়ে ধরলেন, পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতের গ্রামেগঞ্জে জাতপাতের প্রবল বৈষম্যের কালে মুখে যাই বলুন, কাজে এই ভেদাভেদকে কাটিয়ে উঠে মুচি সম্প্রদায়ের অস্পৃশ্য বলে দাগিয়ে দেওয়া কোন মানুষকে জড়িয়ে ধরে প্রণাম করার মতো উদারতা কোন সমাজ-বিপ্লবীর ক্ষেত্রেই সহজে চোখে পড়েনি। কিন্তু, উদয়শঙ্কর শিল্পকে অকৃত্রিম ও অকৃপণভাবে ভালোবাসতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো সমস্ত প্রথাগত সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে শিল্পী-মানুষটিকেও ভালোবাসতে পেরেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন স্বকীয় জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রবহমান ধারায় যাঁর দীপ্তি আজও জাজ্বল্যমান...