সত্যজিতের ভাষায়, তিনি ‘মরিস শিভ্যালিয়র অফ ইন্ডিয়া’
বিখ্যাত চিত্র সমালোচক অ্যানড্রু রবিনসন তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘Chakravarty recalls Chaplin at his best. Instead of a moustache, he has a pair of bulbous as a frog’s which he opens wide with every emotion known to Man’
‘চক্রবর্তী’ ওরফে তুলসী চক্রবর্তী।
টাক মাথা, গোলগোল চোখ, নেয়াপাতি ভুঁড়ি। ধুতি-ছাতা-পাঞ্জাবিতে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই এই ‘মরিস শিভ্যালিয়র’কে।
হাওড়ার ২, কৈলাস বসু থার্ড বাইলেনের ঘিঞ্জি গলি থেকে ব্রিজ পার হয়ে আসতেন টলি পাড়ায়। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী।
চাকর, হোটেলের ম্যানেজার, ছাপোষা কেরানি, হঠাৎ বড়লোক- অভিনয়ের ন্যাচারালিজম তাঁর অস্ত্র।
সত্যজিৎ রায় তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদেশ হলে তুলসী চক্রবর্তী অস্কার পেতেন’।
তুলসী চক্রবর্তী ‘ফ্লোর’-এ থাকলে তাঁকে ভয় পেতেন রাশভারী ছবি বিশ্বাসও। ক্যামেরার সামনে তিনি অন্যরকম কিছু করতেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর যেভাবে বেঁচে থাকার ধরন অবিকল তাই করতেন ক্যামেরার সামনে। আশপাশে যে সব মানুষদের দেখতেন তাদেরই ধারণ করতেন নিজের শরীরে ।
জানতেন শরীরী অভিনয়। কোনও সংলাপ ছাড়াই শুধুমাত্র ‘এক্সপ্রেশন’ দিয়ে কীভাবে জীবন্ত কিংবদন্তীর জন্ম দিতে হয় তা তিনি জানতেন।
জন্ম ১৮৯৯-এর ৩ মার্চ।
বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী। বাবা রেল কোম্পানীতে চাকরি করতেন সেই সূত্রে নানা জায়গায় ঘোরার সুযোগ হয়েছিল। ছোট থেকেই ভবঘুরের অদৃশ্য ঝোলাখানা যেন কাঁধে উঠিয়ে নিয়েছিলেন নিজের অজান্তেই।
বাবার অকাল মৃত্যুতে অকালেই ছাড়তে হয়েছিল পড়াশোনা
কৃষ্ণনগরে গ্রাম থেকে মা নিস্তারিনী দেবীর সঙ্গে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় জ্যাঠামশাই-এর কাছে চলে এলেন।
জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর গান-বাজনার দল ছিল। সেখানে গাইতেন তিনি। কখনও শ্যামাসঙ্গীত, কখনও কীর্তন, আবার কখনও কবি গান। সঙ্গে হারমোনিয়াম, তবলার অভ্যাস।
অভিনেতা হওয়ার আগে নানা রকম পেশায় ছিলেন। কখনও চাটের দোকানে বয়-এর কাজ।
ঘড়ির দোকানে ঘড়ি মেকানিক। নিজের চাকরি নিয়েছিলেন একবার। তবে কিছুদিন পরেই ভূমিকা বদল। জাহাজে করে সোজা বর্মামুলুক। জাহাজেই হয়ে গিয়েছিল কাজের জোগাড়। এবারের চাকরি বাঘ-সিংহী-র সঙ্গে।
সার্কাসের দলে জীব-জন্তু সামলাবার দায়িত্ব। ‘বোসেস সার্কাস’- এর শো-এ জোকারের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেখান থেকেই উর্দু আর হিন্দি ভাষায় দখল। প্রায় মাতৃভাষার মতই বলতে পারতেন।
ছাপাখানায় চাকরি নিয়েছিলেন একবার। কম্পোজিটরের কাজ করতেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল, পোস্টার ছাপা হত। সেসব দেখে মাথার ওপর কিলবিলিয়ে উঠল অভিনয়ের পোকা। গিয়ে ধরলেন জ্যাঠা মশাইকে।
ছাপাখানার ৩২ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে সোজা স্টার থিয়েটারে। অভিনয়ই যে অব্যর্থ নিয়তি।
স্টার থিয়েটারে তাঁর বেতন ছিল ৮ টাকা। কাজের অবসরে উইং-এর পাশে বসে ‘থেটার’ দেখতেন। এক সময় সুযোগ এল। আড়াল থেকে নয়, একেবারে মাঝ-মঞ্চে। দুর্গেশনন্দিনীতে অভিনেতার ভূমিকায়।
সিনেমার পর্দা থেকে নাটকের মঞ্চ- পরবর্তী দশক ধরে এই হয়ে দাঁড়ালো তাঁর অবাধ চলন ক্ষেত্র।
অভিনয়ের জন্য জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব জানতেন। একবার একটা থিয়েটারে অভিনয় করতে এসে দেখেন রাজার নাগরার অভাব। এদিকে শো শুরুর তাড়া। সামাল দিতে নিজেই লেগে গেলেন নাগরা তৈরিতে। মোজার ওপর রং দিয়ে এঁকে উঠে গেলেন স্টেজে!
৩১৬ টা বাংলা এবং ২৩ টা হিন্দি ছবি করেছিলেন।
যৎসামান্যে দিনপাত তাঁর কাছে ছিল স্বাভাবিক জীবনবোধ। পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেও এই নীতি থেকে এতটুকু সরতে চাননি। কী উত্তমকুমার কী সত্যজিৎ রায় সকলের ক্ষেত্রেই তাঁর ‘স্ট্যান্ড পয়েন্ট’টা ছিল একই। তাঁর ‘ডেলি রেট’ ১২৫ টাকা। তার থেকে এক কানাকড়িও বেশি নিতে নারাজ। প্রতিদিন ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে যাতায়াত। প্রযোজকের দেওয়া ট্যাক্সিভাড়া নেবেন কেন!
সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’ ছবির জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে ১৫ টাকা চেয়েছিলেন তিনি, যেহেতু বেশি দিনের কাজ। তড়িতাহত হয়েছিলেন পরিচালক। জানিয়েছিলেন ছবির নায়ক এত কম টাকা তিনি দিতে পারবেন না!