পাথুরেঘাটার ঠাকুর পরিবারের বউ হেমসুন্দরী বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন, স্বামী যদুনন্দন মারা যাওয়ার (১৮৬২) কিছুদিন পরেই। স্বামী কী, সেটা জানার আগেই মাত্র বাইশ বছর বয়সে স্বামী মারা গেলেন। সেকালে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর দশ-বারো বছরের ফারাকটা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে, হেমসুন্দরীর বয়স তখন ধরাই যেতে পারে বারো-তেরো বছরের বেশি নয়। তবে, সেই বয়সেই শ্বশুরবাড়ি যে কী জিনিস জানতে বাকি রইল না। সেখানকার চাপাচাপি আর সহ্য করতে না-পেরে বাধ্য হলেন পথে নামতে।
হেমসুন্দরী ঘুরতে ঘুরতে এলেন মিরাটে। চাকরি নিলেন আয়ার। সেখানে আলাপ হল খ্রিস্টান সাংবাদিক প্যায়ারেলালের সঙ্গে। তারপর প্রেম ও বিয়ে।
হেমসুন্দরীর দুই মেয়ের জন্ম দিলেন, তাদেরই একজনের নাম প্রভাবতী। প্রভাবতী থিয়েটারে ছোটখাটো পার্ট করতেন আর নাচতেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হল আলি বক্স নামের এক ভদ্রলোকের। ইনি শায়রি লেখেন, সুর দেন, তবলা-হারমোনিয়াম বাজান। আলাপ থেকে প্রেম এবং বিয়ে। বিয়ের পর প্রভাবতীর নাম হয়ে গেল, ইকবাল বেগম।
ইকবাল বেগমেরই মেয়ে মীনাকুমারী। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল, মেহজুবীন। ডাক নাম, 'মুন্না'।
১৯৩৩ এর ১ আগস্ট মীনাকুমারীর জন্ম। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে, কিন্তু, মা জন্ম দিলেন তাঁকে। এই ‘না-চাওয়া’ মেয়েটাই চার বছর বয়স থেকে বাপ-মা আর ছোট বোনের মুখে অন্নসংস্থানের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াল!
আলি বক্সের তখন এমনই দুরবস্থা যে, সংসার চালানোর ক্ষমতাটুকুও নেই। মীনার স্বপ্ন ছিল স্কুলে যাওয়ার, বাবার স্বপ্ন মেয়েকে ভাঙিয়ে দুটো পয়সা ঘরে তোলার। একদিন বাবার স্বপ্নই পূরণ হল, ‘লেদারফেস’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করে ১৯৩৯ সালে পেলেন একদিনে পঁচিশ টাকা। সেই হল শুরু।
ছোট থেকেই বাবার কাছে গান শিখেছিলেন মীনা। তাই পরের ছবি ‘অধুরি কাহানি'-তে গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন।
ব্যবসায়িক ব্যাপারে বাবা বিচক্ষণতা অসাধারণ। তিনি দেখলেন, মেয়ে যখন ঘরে পয়সা আনছে, তখন তাকে নিরক্ষর করে রাখলে চলবে না। মীনার রোজগারেই ঘরের অবস্থা ফিরছে। তাই বাড়িতেই এক মাস্টারমশাই রেখে হিন্দি, উর্দু আর ইংরেজি শেখাতে লাগলেন।
স্কুলের চৌকাঠ আর কোনদিনই মীনাকে মাড়াতে হল না। স্টুডিওর চৌকাঠই তাঁর কাছে একমাত্র সত্য হয়ে দাঁড়াল। নিছক টাকার জন্য কাজ করতে গিয়ে সে-সময় ভালোমন্দ বাছাই করার বালাই ছিল না, তাছাড়া কোন্ ছবিতে কাজ করবেন ও কত টাকায় কাজ করবেন--এসব তো বাবাই ঠিক করতেন, মীনা শুধু ছিলেন বাবার হাতের পুতুলমাত্র।
১৯৪০ সালে ‘এক হি ভুল’ ছবি করতে গিয়ে প্রথম তাঁর নাম মেহজুবীন থেকে হল, 'বেবী মীনা'। সাতচল্লিশে মা মারা গেলেন লাং ক্যান্সারে। তখন বাবাই হয়ে উঠলেন তাঁর কেরিয়ার কন্ট্রোলে সর্বেসর্বা।
মীনা যত বড় হতে লাগলেন, তাঁর অভিনয় জীবন যত ব্যস্ততম হয়ে উঠল, ততই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের শূন্যতা বাড়তে লাগল। কোন পুরুষের কাছ থেকেই জীবনে প্রেম পেলেন না তিনি। সারাটা জীবন যেন তাঁর শূন্যতার হাহাকারে ভরা। সংসারে বাবার ভালোবাসা পেলেন না। সংসারের বাইরে একজন অল্প সময়ের জন্য ভালোবাসার আলো নিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু, অচিরেই দেখা গেল তা নিছক আলেয়া মাত্র।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন পরিচালক কামাল আমরোহী ‘আনারকলি’ ছবি করবেন, খুঁজছেন নায়িকা আনারকলিকে। সে-সময়ই একদিন ‘তামাশা’ ছবির সেটে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল মীনাকুমারীর। আলাপটা করিয়ে দিলেন অশোককুমার। সেটা ১৯৫১ সাল।
কামাল মীনাকে অফার করলেন ‘আনারকলি’র চরিত্র। কন্ট্রাক্ট সাইন হয়ে গেল। ঠিক তারপরই একদিন কার অ্যাকসিডেন্ট হল মীনার। মারাত্মক জখম হলেন তিনি। ভর্তি করা হল তাঁকে পুনার হাসপাতালে। সেখানে কামালের যাতায়াত এবং চিঠি আদানপ্রদান চলতে লাগল ক্রমাগত। চারমাস পর মীনা যখন ছাড়া পেলেন হাসপাতাল থেকে, দুজনের প্রেম তখন জমে ক্ষীর।
অ্যাকসিডেন্টে মীনার বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল এমন জখম হয়েছিল যে কেটে বাদ দিতে হল। তাতে অবশ্য তাঁর কেরিয়ারে সমস্যা হল না। ছবিতে অভিনয়ের সময় তিনি বাঁ-হাত এমন ভাবে ঢেকে রাখতে শুরু করলেন, যাতে আঙুল দেখা না যায়।
যাই হোক, কামাল ব্যাচেলার ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী, সংসার সবই ছিল। তবু মীনাকে বিয়ে করলেন লুকিয়ে। কামাল যেমন এই বিয়ের কথা প্রথম স্ত্রীকে জানালেন না, মীনাও তেমনি জানালেন না বাবাকে। তবে ব্যাপারটা গোপন রইল না। সিমেমার মতোই একদিন মীনা আর কামালের ফোনালাপ লুকিয়ে শুনে বাবা জানতে পারলেন পুরো ব্যাপারটা।
জেনে বাবার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। তাঁর সোনার ডিমপাড়া হাঁস, রোজগেরে মেয়ে যে বেহাত হয়ে যাচ্ছে! এ তো সহ্য করা যায় না!
বাবা ক্রমাগত চাপ দিতে লাগলেন কামালকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। মীনা চলে যেতে চাইলে বাবা বাধা দিলেন। কলকাঠি নেড়ে বাধ্য করলেন সঙ্গে থাকতে। মীনা তখন অসহায় হয়ে জানালেন যে, তিনি বাবার সঙ্গে থাকতে, তাঁর হাতে সব টাকা তুলে দিতে রাজি; মরিয়া হয়ে জানালেন, কামালকে ছাড়তে রাজি নন।
ওদিকে যতদিন যাচ্ছিল মীনা অবাক হচ্ছিলেন, আহত হচ্ছিলেন। কামালের চরিত্র আরও বেশি স্পষ্ট হচ্ছিল তাঁর কাছে। লোকটা শিল্পী হিসেবে অনেক বড়। কিন্তু, মানুষ হিসেবে?
সারাক্ষণ মীনার ওপর সন্দেহ ও নজরদারি, মীনার খ্যাতিতে জ্বালা—এসবই তাঁদের দাম্পত্যে ডেকে আনল অশান্তি। তাঁর নজরদারিতে মীনার মেকআপ রুমে কারও ঢোকার অধিকার ছিল না। একবার গুলজার তাঁর সঙ্গে সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলেন বলে কামাল নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে মীনাকে চড় মারালেন। মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারে অপমানে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললেন তাঁকে।
‘সাহেব বিবি গোলাম’-ছবিতে অভিনয় যে মীনার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, মীনা একথা নিজেই জানিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। এই ছবি তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল।
'সাহেব বিবি গোলাম'-ছবির প্রিমিয়ারে সোহরাব মোদী কামাল ও মীনাকে মহারাষ্ট্রের গভর্নরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে যখন বললেন, ‘ইনি অভিনেত্রী মীনাকুমারী, আর ইনি এঁর স্বামী কামাল আমরোহী’, তখন সেটা কামালের আঁতে লাগল এবং মোদীর কথাটা শুধরে দিয়ে বললেন, ‘উঁহু, আমি কামাল আমরোহী, আর ইনি আমার স্ত্রী মীনা’। আর তারপরই তিনি শো ছেড়ে চলে গেলেন।
তারপর ডিভোর্স।
এরপর পরম শূন্যতা এল মীনার জীবনে। সেই শূন্যতার মাঝে মীনাকুমারী অনিদ্রা রোগে ভুগতে লাগলেন। ডাক্তার ঘুমের ওষুধের বদলে ব্রাণ্ডি খেতে বললেন। হতাশার মাঝে ওষুধটা আর ওষুধ থাকল না। নেশা হয়ে দাঁড়াল। তাঁর অভিনীত চরিত্র ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর বৌঠান হয়ে গেলেন ধীরে ধীরে, রিল আর রিয়াল মিশে গেল যেন তাঁর জীবনে ভবিতব্যের মতো।
সে এক টালমাটাল সময়। এই সময়টায় একটু আশ্রয় চেয়ে কখনও গুলজার, কখনও ধর্মেন্দ্র, কখনও বা শ্রবণ কুমারের কাছে প্রেম ভিক্ষা করলেন। পেলেন না। আসলে, পুরুষের কাছ থেকে ভালোবাসা তিনি কখনই পাননি। দিনে দিনে বুকে জমল শুধু হাহাকার, এই হাহাকারেই নিজেকে তিলে তিলে শেষ করলেন তিনি।
এই বেদনাময় জীবনের কথা শোনার মতো সরব সঙ্গী ছিল না কেউ, নীরব সঙ্গী ছিল একমাত্র কাগজ আর কলম। বুকের কান্না আর চোখের জল শায়রী হয়ে গান হল, কান্নামিঠে গান—
‘পিয়াস জ্বলতে হুয়ে কাঁটো কি বুঝায়ি হোগি
রিস্তে পানি কো হাথেলি পে সাজায়া হোগা।
মিল গয়া হোগা অগর কোই সুনেহরি পত্থর,
আপনা টুটা হুয়া দিল ইয়াদ তো আয়া হোগা।’
আর এই শায়রীই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল তাঁর জীবনকথা, তার আখরেই লেখা রইল তাঁর হাহাকার, তাঁর জীবন-দর্শন...