চেনা গিরিশের অজানা সংবাদ

গিরিশ ঘোষ ছিলেন অষ্টম গর্ভের সন্তান। গিরিশ যখন ছোট্টটি, তখন আর একটি ভাইয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের হল সূতিকা। সেই যে বিছানায় পড়লেন মা, আর তাঁকে উঠে দাঁড়াতে হল না। দিনে দিনে তিনি রুগ্ন হলেন, আরও শীর্ণ হলেন। গিরিশের তেমন জ্ঞানগম্যি হবার আগে চলেও গেলেন। মাকে কাছে পাবার আর অবসর হল না। চোখের সামনে অভাবে-অনটনে, অসুখে-বিসুখে কয়েকটি ছেলেমেয়ের মৃত্যু দেখে বাবাও মারা গেলেন। গিরিশের বয়স তখন সবে ষোল। এই বয়সেই সংসারের ভার এসে পড়ল তাঁর ওপর। ঘর সামলাতে মাথার ওপর রইলেন শুধু বাল্যবিধবা বড়দি কৃষ্ণকিশোরী। 

স্কুল ছেড়ে গিরিশ ঢুকলেন নীলকর সাহেবের আপিসে কেরানির চাকরিতে। আয় সামান্যই কোনরকমে সেই আয়ে দিন যাচ্ছিল চলে, কিন্তু বাইরে পা রেখে গিরিশ বাঁধন ছাড়া হবার সাহস পেলেন, সংস্কারের শেকল গেল খুলে। তবে, এরই মাঝে বাংলা-ইংরেজি সাহিত্য এবং পুরাণপাঠের অভ্যেস তাঁর বজায় রইল। 

তারই মাঝে বাগবাজারের ‘গঙ্গার নীর স্নিগ্ধ সমীর’ আর ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ তাঁর মনে কবি-গীতিকার হওয়ার বাসনা জাগাল। এ-ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভার প্রমাণও তিনি দিলেন। একদিন কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়িতে সাহিত্যিক দেবেন্দ্রনাথ বসু সূর্যাস্ত নিয়ে কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় গিরিশকে আহ্বান করলেন। হাজির হবার পর বলতে-না-বলতেই গিরিশ মুখে মুখে কবিতা রচনা করে ফেললেন তৎক্ষণাৎ :

‘সিত, পীত, লোহিত, হরিত

 মেঘমালা গগন ভূষিত

 সূর্য কিরণ, লোহিত তপন

 নাবিল নাবিল ডুবিল সাগরে।’

ভাষা ও ছন্দের ওপর গিরিশের এমন দখল দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। এই কবি-প্রতিভাকে সম্বল করে পরবর্তীকালে কবিতার পাশাপাশি নিজের ও অন্যের নাটকের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন গিরিশ।

উনিশ শতকের বাগবাজারের সংস্কৃতিতে কথকতা, কবিগান, পাঁচালি, আখড়াই, হাফ আখড়াই তো ছিলই; আর ছিল যাত্রা। যাত্রার পালাগান শুনতে শুনতে বালক গিরিশের ইচ্ছে হত অভিনেতা হওয়ার। পরে তিনি শুধু অভিনেতাই হলেন না, বাংলা নাট্যজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে ছাড়লেন।

নাট্যকার হবার সাধ কখনও মনে জাগেনি। তবু, নাটক করতে এসে নতুন পালা লেখার জন্য কোনভাবেই কাউকে না-পেয়ে নিতান্ত দায়ে পড়ে নাটক রচনার ভার নিতে হল গিরিশকে। তবু নিজে কলম ধরলেন না। ব্যাসদেবের মতো নিজে চরিত্রের ভূমিকায় ডুবে গিয়ে একের পর এক সংলাপ বলে যেতে লাগলেন, আর তাঁর নাট্যদলের কেউ-না-কেউ গণেশের 'মহাভারত' অনুলিখন করার মতোই শুনে শুনে সে-সব লিখে যেতে লাগলেন খাতায়।

গণেশ অবশ্য বুদ্ধি করে ব্যাসদেবের শ্লোকরচনার বেগ সংবরণ করতে পেরেছিলেন মানে বুঝে বলার অছিলায়, কিন্তু গিরিশকে আটকাবে কে? যিনি লিখতেন তিনি দোয়াতে কলম ডোবানোর সময়টুকুও পেতেন না। তবে এভাবেই গিরিশ মুখে মুখে রচনা করেছিলেন ‘চৈতন্যলীলা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘বলিদান’, ‘মীরকাশিম’, ‘বুদ্ধচরিত’, ‘শাস্তি কি শান্তি’-র মতো অনবদ্য সব নাটক। এই কবি-গীতকার-গল্পকার-নট ও নাট্যকারের জন্ম হয়েছিল, ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি আর মৃত্যু হয়েছিল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...