আদর্শে-বিরোধে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্র চক্রবর্তী

ঘটনাটা একই সঙ্গে একটু বিরোধের এবং অনেকটা বন্ধুত্বেরও। আর সেটা কবি ও মানুষ হিসেবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থানটিকেই স্পষ্ট করে। ঘটনাটা এ-রকম...

আমরা জানি যে, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘উলঙ্গ রাজা’ নামের একটি কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আমরা এও জানি যে, সেই কবিতায় একটি শিশু, নিষ্পাপ একটি শিশু সভ্যতার বর্বরতার দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছিল, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ 


সেই প্রশ্নে স্বদেশি সমাজ-রাজনীতির আঙিনায় দাঁড়িয়ে নীরেন্দ্রনাথ বিদ্ধ করেছিলেন নব্য উপনিবেশবাদের আগ্রাসনকেও। 


বন্ধু নীরেন্দ্রর এই সপাট প্রশ্নমুখর বিরোধিতা ভালো লেগেছিল বামপন্থী কবি বীরেন্দ্রর। তাছাড়া পাঠকসমাজের মধ্যেও কবিতাটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল। এরই মধ্যে পাঠক জানলেন না, কিন্তু একটি ঘটনায় বীরেন্দ্র তাঁর কবিমানসে দারুণ এক ধাক্কা খেলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ধাক্কাটা কেন লাগল?

ধাক্কাটা লাগল তখনই, যখন কবিতা লেখা ও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কিছুকাল পরেই অজ্ঞাত কারণে একটি প্রভাবশালী পত্রিকার দপ্তরের চাকরিতে নীরেন্দ্রনাথের পদোন্নতি হল এবং মাইনে বেড়ে গেল। (বামপন্থীরা মনে করতেন সেই দপ্তরটি ছিল বুর্জোয়াদের আখড়া। ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সেরকম ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।)

Birendra1

ফলে, দপ্তরের স্বরই যেন নীরেন্দ্রনাথ স্বর হয়ে উঠতে লাগল। সেটাই স্বাভাবিক। ফরাসি চিত্রপরিচালক গোদার একবার বলেছিলেন যে, তুমি যখন ঘুমিয়ে আছ, তখন তোমার রাতের ক্রিমের মধ্য দিয়েই তোমার শরীরে নব্য উপনিবেশবাদ কীভাবে বাসা বাঁধছে, তুমি জানতেও পারছ না।-এও যেন তাই। 

আসলে, শোষিত মানুষের কথা বলতে এসে নীরেন্দ্রনাথ শেষমেশ বিপক্ষ শিবিরেরই একজন হয়ে গেলেন!--এই বিস্ময়ই বীরেন্দ্রকে সপাট ধাক্কা দিল। 

সেই জায়গা থেকেই একটি কবিতা লিখলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতার নাম, ‘নীরেন, তোমার ন্যাংটো রাজা’। 

কবিতার কয়েকটি চরণ-


‘নীরেন! তোমার ন্যাংটো রাজা

পোশাক ছেড়ে পোশাক পরেছে!

নাকি, তোমার রাজাই বদলেছে?

....................................

পোশাক ছাড়া নীরেন, তুমি,

তুমিও ন্যাংটো।

....................................

কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর;

তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে!'


এই সমালোচনা নীরেন্দ্রনাথ বীরেন্দ্রর মতো গুণী, সহযোদ্ধা ও বন্ধু এক কবির কাছ থেকে মাথা পেতে নিলেন। কোনরকম প্রত্যুত্তর দিয়ে আসর গরম করতে গেলেন না। কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে নামলেন না। কিন্তু, কেন এই সমালোচনা মাথা পেতে নিলেন নীরেন্দ্রনাথ? 

সত্যি বলতে কী, কবি ও মানুষ হিসেবে বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একেবারেই অকৃত্রিম। কোন ভান ভণিতা তাঁর ছিল না। তিনি নিপীড়িত মানুষের কথা বলতে এসেছিলেন, সারাজীবন তাদের কথাই লিখে গেছেন। যখনই পন্থা আর আদর্শের আগল এসে পথ আগলেছে, তখনই তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘রাস্তা কারও একার নয়’!

যৌবনে অনুশীলন সমিতির হাত ধরে স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি গরীব ও মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার এক নতুন মানে খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই অচিরেই সভ্য হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির। 

তারপর চোখের সামনে যখন দেখলেন পার্টির গাঙে বেনোজলের বান ডাকতে, তখনই মতান্তর ঘটল। চোখের সামনে দেশটাকে স্বাধীন হতে দেখলেন। দেখলেন, শাসন ও শোষণের আর এক রূপ। আশাভঙ্গ হল। দেখলেন, মানুষের স্বপ্ন নিয়ে চলছে আখের গোছানোর খেলা। পার্টির ধামাধারী আর স্বাধীন স্বদেশের ঘাড়ে চেপে বসা মানুষ--সকলের এক অবস্থা!

Birendra2

প্রতিবাদে লিখলেন কবিতা। কবিতার নামও ‘প্রতিবাদ’: 


‘এভাবে মানুষ নিয়ে খেলা

মানুষের স্বপ্ন সাধ বিশ্বাস সম্মান নিয়ে 

মানুষের মস্তিষ্ক হৃদয় নিয়ে

হৃৎপিণ্ড ধমনী রক্ত অস্থি নিয়ে খেলা

চক্ষু জঠর গর্ভ পৌরুষ মাতৃত্ব নিয়ে খেলা

................................................

এর চেয়ে আর কী নরক, স্বাধীন স্বদেশ।’


বুঝলেন এখান-ওখান-সমস্তখানই সেই এক। কোথাও বিস্তৃত আকাশ নেই, কোথাও যেন সুস্থ আদর্শ নেই। আসলে :


 ‘...আমরা সবাই যে ন্যাংটো।

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই

 রাজার রাজত্বে!’ 


কমিউনিজমের স্বপ্ন দেখলেই যে বিশ্বাসে না-মিললেও পার্টির সঙ্গে জুড়ে থাকতে হবে, এমন ভাবনায় আস্থা ছিল না তাঁর। মধ্যপন্থী হয়ে বেঁচে থাকা তাঁর কাজ নয়। কাজেই ছেড়ে দিলেন পার্টির সভ্যপদ। কিন্তু তাই বলে সাম্যবাদের স্বপ্ন ছাড়লেন না। সমগ্র কবিতাবলী তার প্রমাণ।


তিনি আজন্ম প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তাই একটিও কবিতা তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় লেখেননি। 


আসলে, সংগ্রামটা ছিল তাঁর মজ্জাগত। তাই কারও কাছে মাথা বিকিয়ে না-পার্টি, না-নয়া উপনিবেশ—কারো জন্যই তিনি কবিতার আকারে ইস্তাহার লিখতে বসেননি। কবিতার মধ্য দিয়ে সারাটা জীবন তাই আপোষহীন সংগ্রামের কথাই বলেছেন। এমনকি আটের দশকে ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে ক্যানসারের সঙ্গে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তেও তাই তিনি লিখেছেন:


‘এ লড়াই মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের

আর হার-জিত দুটো কথাই যখন অভিধানে রয়েছে

বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে মাটি ছেড়ে দেবে না।

....................................

কেউ কেউ বাড়ি ফেরে না, কিন্তু যারা ফেরে, তাদের

কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই নবজীবনের গান।’


মৃত্যুমুখর সমাজের অলিন্দে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে এভাবেই শেষ অব্দি সৎ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘নবজীবনের গান’ শুনিয়ে যান যে কবি, তাঁর সমালোচনা মাথা পেতে নিতে তাই নীরেন্দ্রনাথের এতটুকু বাধেনি। এটা নীরেন্দ্রনাথেরও উদারতা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...