অচেনা ঋত্বিকের স্মরণে
তিনি চলচ্চিত্রের। তিনি মানুষের। তিনি জীবনের। তিনি আগুনের। জল নয় আগুনই করেন পান।
দূর বাংলার প্রান্তর ধরে মাঠ বরাবর দৌড়চ্ছেন এক প্রবীণ। একটা ঝোলায় অসংখ্য না বলা, অসমাপ্ত গল্প। হাতে থাকা বাংলা মদের বোতল টা একসময় পড়ে যায়। সেই ভাঙা টুকরো কাঁচে পা কেটে রক্ত ঝরছে। তিনি দুর্বার গতিতে ছুটছেন। মাটিতে লাগা রক্তে একে একে ভেসে উঠছে মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, যুক্তি তক্ক গপ্পো...
ঋত্বিক ঘটক। স্পর্ধা যাঁর শিরায় ছোটে ।
নাগরিক থেকে শুরু; শেষ যুক্তি তক্ক গপ্পো।লাগামহীন বদলের কথা তাঁর সব ছবিতেই প্রাসঙ্গিক।
পরিচালক ঋত্বিক আর সাধারণ ঋত্বিকের মাঝের যাত্রাটা নিয়েও একটা গোটা চিত্রনাট্য হতে পারে।
এক সাক্ষাত্কারে নিজেকে বলেছিলেন ‘রাস্তার কুকুর’।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণে কী ভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন?’
উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘আমি একটি ‘জিগজ্যাগ’ পথ ধরে ফিল্মে এসে পড়েছি। বাবার ইচ্ছে পূরণ হলে একজন ‘ইনকাম-ট্যাক্স অফিসার’ হতাম। কিন্তু সেই চাকরিটি পেয়েও আমি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই। চাকরিতে থাকলে আজ কমিশনার বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হতাম, হয়তো।“
এক যে ছিল ঋত্বিক। যে গল্প লিখত, চুটিয়ে রাজনীতি করত, গণনাট্যের আদর্শ পৌঁছে দিচ্ছিল দিক্বিদিকে। লিখত নাটক।
এক যে ছিল ঋত্বিক।যে পদ্মার জলে ভেলা ভাসিয়ে মিশে যেত মেঘের দলে। কিন্তু যুদ্ধ ও কাঁটা তারের রাজনীতি তাঁর শরীর থেকে উপড়ে নিয়েছিল সবুজ মন।
তারপর এলেন আর এক ঋত্বিক।খুঁজে পেয়েছেন আঁকড়ে ধরার জমি। ‘একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা এখুনি বলতে চলচ্চিত্রই একমাত্র মাধ্যম’। এই ছিল তাঁর অভিমত।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের ভাষা তাঁর স্বকীয়। নিবিড় ভাবে শুনলে বিষাদের বেহালা বেজে ওঠে।একজন শিশুর কাছ থেকে তার মাকে কেড়ে নেওয়ার মতনই যন্ত্রণা দিয়েছিল তাঁকে দেশভাগ।
তিনি পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন নিজেকে। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন!
ঋত্বিক একান্তই বাঙালি এক শিল্পী।মতামত সত্যজিত রায়ের। তাই ঋত্বিকের শিল্প উৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়। সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে।
বহু প্রেম আর বহু জন্মের নির্বাক সাক্ষী পুরানো ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনে জন্ম হয় যমজ ভাই-বোন, ঋত্বিক-প্রতীতির। ডাকনাম ছিল ভবা আর ভবী। ঋত্বিকের পুরো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক।
ছোটবেলা থেকেই ঋত্বিক অন্য ধাঁচের। তিনি না ছিলেন সাধারনের মধ্যে,আবার না ছিলেন পরিচিত অসাধারণের তালিকায়। ছেলেবেলা থেকে আমৃত্যু জীবনকে তিনি নিজের মতো করে গড়েছেন, ভেঙেছেন। তারপর আবার নতুন করে গড়েছেন।
ঋত্বিক রাজনীতি করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। গণনাট্যের কর্মী ছিলেন। নাটক লিখেছেন, করেছেন অভিনয়। লিখেছেন গল্প। ছাত্রাবস্থায় ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন।
তিনি নীলকণ্ঠ বাগচীর মত নির্ভেজাল। অকপট থাকতে চেয়েছেন আজীবন। আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বুঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি ।
তাঁর এক একটা ছবি সমাজের আয়না।
দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা একটি শরণার্থী পরিবারের জীবন যুদ্ধই-‘নাগরিক’।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ নিকষ কালো অন্ধকারে আলোর পথ দেখায়।মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে জীবনকে আগলে রাখে।
বাড়ি থেকে পালিয়ে – একজন ছোট্ট ছেলের চোখে শহর কলকাতাকে দেখা । নাকি ঋত্বিকের গল্পই এটি? তিনি নিজেও তো কয়েকবার পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।
অযান্ত্রিক ছবিতে নায়ক একজন ড্রাইভার। নায়িকা তার গাড়ি। সম্পর্ক ও আবেগের নতুনতর বুনন।একটি যন্ত্র যখন ভালবাসার আর্তি জানায়।
‘কোমল গান্ধার’ ছবিতেও জীবনের জয়গান। দুই বাংলার মিলনের সুর।
‘সুবর্ণরেখা’য় ফুটে উঠেছে দেশভাগের কুফল।
এই তিনটি ছবিকে একত্রে পার্টিশন ট্রিলজি বা দেশভাগত্রয়ী বলা হয়ে থাকে।
ব্রাত্যজন মালোদের জীবন বৃত্তান্ত ও মাটি ঘেঁষা মানুষের জীবন সংগ্রাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। তিতাস পাড়ের মৎস্যজীবীদের জীবনের সংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিচ্ছবি সেলুলয়েডের ফিতেয় জীবন্ত করেছেন নির্দেশক।
তারপর যুক্তি তক্ক গপ্পো। জীবন দর্শনের প্রতিফলন । আত্মজীবনীমূলক ছবি। দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন- এসবের প্রেক্ষাপটে জীবনের টানাপড়েন -কে ফুটিয়ে তুলেছেন সযত্নে।
অনেকেই তাঁকে সাহিত্যের জীবনানন্দ মনে করে থাকেন। সেই অনুমান এক কথায় যথার্থ। কারণ তিনিও ছেড়ে গিয়েছেন অসময়ে।আজকের তারিখে, মাত্র পঞ্চাশ বছরে।
দুর্ভাগা বাঙালি। দুর্ভাগা সেই সময়। যেখানে তিনি ছিলেন একজন অঘোষিত বিপ্লবী। তিনি মানুষের কথা বলতে চেয়েছিলেন। তবে সেই মানুষই তাঁর কথা রাখেননি। একবারও ভাবেননি কীভাবে ভাবা প্র্যাকটিস করতে হয়।