অনেকেই হয়তো জানেন না যে, অভিনেতা পাহাড়ী সান্যালের পোশাকি নাম ‘নগেন্দ্রনাথ'। তবে, তাঁর নামকরণের একটি ইতিহাস আছে।
বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে অ্যাকাউন্ট্যান্ট। নগেন্দ্রনাথের যখন জন্ম হয়, তখন তাঁর দার্জিলিং–এ পোস্টিং। পাহাড়-পর্বতের শহরে ছেলের জন্ম বলে, একদিকে যেমন তাঁর পোশাকি নাম রাখা হল, ‘নগেন্দ্রনাথ’ ('নগ', মানে 'পর্বত'), অন্যদিকে তেমনই ডাকনাম দেওয়া হল, ‘পাহাড়ী’। ছবির জগতে এসে, সেই ডাকনামেই নগেন্দ্রনাথের নামডাক হয়েছিল।
বাবা গানবাজনা ভালোবাসতেন বলে ছোট থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ এসেছিল পাহাড়ীর। বাবার কাছেই ছোটবেলায় পেয়েছিলেন সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ। তাঁর যখন দেড় বছর বয়স, তখন মা মারা গিয়েছিলেন, আর বয়স দশ হতে-না-হতেই বাবাও মারা গেলেন। কিশোর পাহাড়ীর সব ভার নিলেন বড়দা। ইনিই পাহাড়ীকে পড়তে পাঠালেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু, সঙ্গীতের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাঁকে সেখানকার পড়া শেষ করতে দিল না, টেনে নিয়ে গেল লক্ষ্ণৌর ভাতখন্ডে মিউজিক ইনস্টিটিউটে। সেখানেই তালিম নিলেন হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের।
১৯৩৩ সাল। কলকাতা তখন ভারতীয় সিনেমার রাজধানী। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগুসহ প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষার সিনেমা এখানে সে-সময় তৈরি হচ্ছিল। সিনেমা তখন সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছে। সিনেমায় গানও এসেছে। কিন্তু প্লেব্যাক আসেনি। কাজেই সিনেমার জন্য চাহিদা বাড়ল সুদর্শন ও সুকন্ঠী অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের। এর সবকটা গুণই ছিল পাহাড়ীর মধ্যে। তাই মাত্র সাতাশ বছর বয়সে লক্ষ্ণৌ থেকে পাহাড়ী পাড়ি দিলেন কলকাতায়। সেই পাড়িরও ইতিহাস আছে।
লক্ষ্ণৌতে থাকার সময় মাত্র একুশ বছর বয়সে পাহাড়ী বিয়ে করেছিলেন। স্বামীস্ত্রীর সুখী সংসার। কিন্তু, সে সুখ সইল না। পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে স্ত্রী মারা গেলেন, ছেলেকেও কিছুতেই বাঁচানো গেল না। মা-বাবাকে তো সেই ছেলেবেলাতেই হারিয়েছিলেন, এবার একমাত্র অবলম্বন স্ত্রীকেও হারালেন অকালে। সব হারানোর এই দুঃসহ শোক পাহাড়ীকে বিহ্বল করে তুলল। শোক চাপতে চাপতে এক সময় নিজেকে সামলে নিলেন বটে, কিন্তু সব হারিয়ে লক্ষ্ণৌতে আর কিছুতেই তিষ্ঠোতে পারলেন না। মনটাই মানল না।
নিজেকে ব্যস্ত রাখতে কিছুদিন রেওয়ারে রাজকুমারের সেক্রেটারির কাজ নিলেন। কিছুদিন পর তাও আর ভালো লাগল না। চলে এলেন কলকাতায়। বলা ভালো, বাস্তব জীবনের দুঃখ ভুলতেই তিনি কলকাতার রুপোলি জীবনে পাড়ি দিলেন।
কলকাতায় এসে পাহাড়ী যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও-তে। সেখানে তখন মাসমাইনেতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়োগ করা হত। এখানে প্রথম যে ছায়াছবিটিতে তিনি অভিনয় করলেন, সেটি হল প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর হিন্দি-উর্দু ছবি, ‘ইহুদি কি লেড়কি’। ছবির গায়ক-নায়ক কে এল সায়গল। পাহাড়ী অভিনয় করলেন রোমান সম্রাটের ভূমিকায়।
লক্ষ্ণৌতে দীর্ঘদিন তিনি বাস করেছিলেন। তাই হিন্দি ও উর্দুতে ছিল তাঁর অসামান্য দখল। পারিবারে বাংলার চল তো ছিলই। তাছাড়া ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতেও ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। তাই অভিনয়-জীবনে বাংলা, হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় দেড়শটি ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে তাঁকে ভাষা সমস্যায় পড়তে হয়নি কখনও।
১৯৩৪-এ নীতিন বসু পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে পাহাড়ী অভিনয় করেছিলেন রজকিনী রামীর দাদা বৈজুর চরিত্রে। এই ছবিতে তিনি একটি গান গেয়েছিলেন। সায়গল ও উমাশশীর সঙ্গে, ‘প্রেম কি হো জয় জয়’।
পরের বছর ১৯৩৫ সাল। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের একটি গৌরবময় মাইল ফলকের সঙ্গে জুড়ে গেল পাহাড়ীর নাম। তাঁর অভিনীত ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির মধ্য দিয়ে ভারতীয় ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক পদ্ধতির প্রবর্তন হল। সেই সঙ্গে তাঁর গাওয়া এই ছবির ‘কেন পরাণ হল বাঁধনহারা’-গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়ও হল।
প্রথম ছবিতে চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই পাহাড়ীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সমগ্র অভিনয় জীবনে সেই চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। গ্রামের আলাভোলা মানুষ, প্রভাবশালী জাঁদরেল বাবা থেকে শুরু করে রসিক, চালবাজ কিম্বা প্রখ্যাত ডাক্তার বা জাজ যেকোনরকম চরিত্র অনায়াস দক্ষতায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। প্রখ্যাত পরিচালকেরা তাঁর কথা মাথায় রেখেই ছবিতে চরিত্র সৃষ্টি করতেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে পক্ষীপ্রেমিক আপনভোলা জগদীশমামার কথা, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে সদাশিব ত্রিপাঠির কথা এ-প্রসঙ্গে বলা যায়। বাংলা ছবিতে তিনি শেষবারের মতো গান গেয়েছিলেন এই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতেই। অতুলপ্রসাদের গান, ‘সে ডাকে আমারে’। অতুলপ্রসাদ শুধু তাঁর প্রিয় সঙ্গীতকারই ছিলেন না, অন্তরঙ্গ বন্ধুও ছিলেন।
ছায়াছবির পাশাপাশি পেশাদার রঙ্গমঞ্চেও তাঁর অসামান্য অভিনয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। সাতের দশকে যখন বাংলা নাট্যচর্চার ডামাডোল পরিস্থিতি, তখন ‘বিশ্বরূপা’য় বিমল মিত্রের গল্প অবলম্বনে ‘আসামী হাজির’ নাটকে তাঁর অভিনয় রসিকমহলে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী সিনেমা-সঙ্গীত ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসনে যেমন স্মরণীয় হয়ে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।